জয়নাল ফ্যাঁসফ্যাঁস গলায় বলল, খুব ভালো আছি স্যার। খুব ভালো। ঘটনাটা বলব?
কী ঘটনা?
পানির উপরে দিয়া হাঁটনের ঘটনা। না বইল্যা যদি মইরা যাই তা হইলে একটা আফসোস থাকব। বলি—? কাছে আইস্যা বসেন। আমি জোরে কথা বলতে পারতেছি না।
মবিন সাহেব কাছে এসে বসলেন। জয়নাল ফিসফিস করে প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলতে লাগল–
ছোটবেলা থাকাই স্যার আমি পানি ভয় পাই। বেজায় ভয়। আমি কোনো দিন পুসকুনিতে নামী নাই, নদীতে নামী নাই। একবার মামারবাড়ি গিয়েছি, মামার বাড়ি হলো সান্দিকোনা–বাড়ির কাছে নদী। খুব সুন্দর নদী। আমি সন্ধ্যাকালে নদীর পাড় দিয়া হাঁটাহাঁটি করি। একদিন হাঁটতেছি— হঠাৎ শুনি খচমচ শব্দ। নদীর ঐ পাড়ে একটা গরুর বাচ্চা পানিতে পড়ে গেছে। গরু-ছাগল এরা কিন্তু স্যার জন্ম থাইক্যা সাঁতার জানে। এরা পানিতে ডুবে না। কিন্তু দেখলাম, এই বাচ্চাটা পানিতে ডুইব্যা যাইতেছে। একবার ডুবে, একবার ভাসে। পায়ের মধ্যে দড়ি পেঁচাইয়া কিছু একটা হইছে। বাচ্চাটা এক একবার ভাইস্যা উঠে আমার দিকে চায়। আমাকে ডাকে। তার ডাকের মধ্যে কী যে কষ্ট। আমার মাথা হঠাৎ আউলাইয়া গেল। আমি যে সাঁতার জারি ঘা, পানি ভয় পাই কিছুই মনে রইল না দিলাম দৌড়। এক দৌড়ে বাচ্চার কাছে গিয়া উপস্থিত। পানি থাইকা বাচ্চাটারে টাইন্যা তুইল্যা দেহি আমি নিজে পানির উপরে দাঁড়াইয়া আছি। আমি নদী পার হইছি হাইট্যা, আমার পায়ের পাতাটা খালি ভিজছে। আর কিচ্ছু ভিজে নাই–এখন স্যার আপনে আমারে বলেন বিষয় কী? ঘটনা কী?
মবিন সাহেব বললেন, এরকম কি আরো ঘটেছে?।
জে না, সেই প্রথম, সেই শেষে। আর কোনো দিন আমি পানিতে নামী নাই। এখন আপনে যদি বলে আরেকবার পানিতে নাইম্যা দেখব। তয় আমি তো সাধুও না— পীর-ফকিরও না…
মবিন সাহেব বলেলেন, কে বলতে পারে! তুই হয়তো বিরাট সাধু–তুই নিজে তা জানিস না।
জয়নাল কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি স্যার সাধারণ মানুষ। অতি সাধারণ, তয় স্যার, সাধু হইতে আমার ইচ্ছা করে। খুব ইচ্ছা করে।
মবিন সাহেব বললেন, আর কথা বলিস না জয়নাল। তোর কষ্ট হচ্ছে, শুয়ে থাক।
আমার কুত্তাটারে পাইছিলেন?
খোঁজ করছি— এখনও পাইনি। পেলে ভাত খাইয়ে দেব। চিন্তা করিস না। রাতে এসে খোঁজ নিয়ে যাব।
জয়নাল হাসল। তৃপ্তির হাসি, আনন্দের হাসি।
রাতে খোঁজ নিতে এসে মবিন সাহেব শুনলেন জয়নাল মারা গেছে। মবিন, সাহেব অত্যন্ত মন খারাপ করে হাসপাতালের বারান্দায় এসে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন রাজ্যের কাক বারান্দায় লাইন বেঁধে বসে আছে। তাদের চেয়ে একটু দূরে বসে আছে কোমরভাঙা কুকুর। কীভাবে সে এতদূর এসেছে কে জানে?
মবিন সাহেব দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। এই জগতে কত রহস্যই না আছে! কোনো দিন কি এইসব রহস্যভেদ হবে?
ভূত মন্ত্র
বাবলুকে একা বাসায় রেখে তার বাবা-মা ভৈরবে বেড়াতে গেছেন। সকালের ট্রেনে গেছেন, ফিরবেন রাত নটায়। এই এত সময় বাবলু একা থাকবে। না, ঠিক একা না, বাসায় কাজের বুয়া আছে।
বাবলুর খুব ইচ্ছা ছিল সেও ভৈরব যাবে। অনেক দিন সে ট্রেনে চড়ে না। তার খুব ট্রেনে চড়তে ইচ্ছা করছিল। তা ছাড়া ভৈরবে ছোট খালার বাড়িতেও অনেক মজা হবে। ছোটখালার বাড়িটা নদীর ওপরে। নিশ্চয়ই নৌকায় চড়া হবে। বাবলু অনেক দিন নৌকাতেও চড়ে না। তাকে ইচ্ছে করলেই নিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু বাবলুর বাবা মনসুর সাহেব তাকে নেবেন না। তিনি চোখ-মুখ কুঁচকে বললেন, নো নো নো। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বেড়ানো আমি পছন্দ করি না। তুমি বাসায় থাক। হোম ওয়ার্ক শেষ কর।
বাবলু ক্ষীণ গলায় বলল, হোম ওয়ার্ক শেষ করে রেখেছি।
শেষ করলে অন্য কাজ কর। দেখি অঙ্ক বই নিয়ে আস, দাগিয়ে দেই। অঙ্ক করে রাখ–ভৈরব থেকে ফিরে এসে দেখব।
বাবলু অঙ্ক বই নিয়ে এলো। মনসুর সাহেব বিশটা অঙ্ক দাগিয়ে দিলেন।
সব করবে। একটা বাদ থাকলে কানে ধরে চড়কিপাক খাওয়াব। সারা দিন আছেই শুধু খেলার ধান্ধায়।
বাবলুর চোখে পানি এসে গেল। সারা দিন সে তো খেলার ধান্ধায় থাকে। খেলাধুলা যা করার স্কুলেই করে। বাসায় ফিরে বাবার ভয়ে চুপচাপ বই নিয়ে বসে থাকে। বাবলু তার বাবাকে অসম্ভব ভয় পায়। বাবাদের কোনো ছেলেই এত ভয় পায় না–বাবলু পায়, কারণ মনসুর সাহেব বাবলুর আসল বাবা না, নকল বাবা।
বাবলুর আসল বাবার মৃত্যুর পর তার মা এঁকে বিয়ে করেন। তবে লোকটা যে খুব খারাপ তাও বলা যাবে না। বাবলুকে তিনি প্রায়ই খেলনা, গল্পের বই এইসব কিনে দেন। কিছুদিন আগে দামি একটা লেগোর সেট কিনে দিয়েছেন।
তবে বাবলুর সব সময় মনে হয় তার আসল বাবা বেঁচে থাকলে লক্ষ গুণ বেশি মজা হতো। বাবা নিশ্চয়ই তাকে ফেলে ভৈরব যেতেন না। বাবলু কোথাও যেতে পারে না। বেশির ভাগ সময় সোবহানবাগ ফ্ল্যাটবাড়ির তিনতলাতেই তাকে বন্দী থাকতে হয়। মাঝে মাঝে তার এমন কান্না পায়। তার কান্না দেখলে মা কষ্ট পাবেন বলে সে কাঁদে না। তার খুব যখন কাঁদতে ইচ্ছা করে তখন সে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে কাঁদে। বের হয়ে আসার সময় চোখ মুছে এমনভাবে বের হয় যে, কেউ কিছু বুঝতে পারে না।
বাবলু বসার ঘরে অঙ্ক বই নিয়ে বসেছে। মনসুর সাহেব বিশটা অঙ্ক দাগিয়ে দিয়ে গেছেন। এর মধ্যে সে মাত্র একটা অঙ্ক করেছে। অঙ্কগুলি এমন কঠিন। বুয়া গ্লাস ভর্তি দুধ রেখে গেছে। দুধ খেতে হবে না খেলে সে নালিশ করবে। গ্লাসটার দিকে তাকালেই বাবলুর বমি আসছে। সে অঙ্ক করছে গ্লাসটার দিকে না তাকিয়ে। এই সময় দরজায় খট খট শব্দ হলো। বাবলু দরজা খুলে দিল। সাতআট বছর বয়েসি দুষ্টু দুষ্ট চেহারার একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। খালি পা। পরনে সাইজে বড় একটা প্যান্ট। প্যান্ট খুলে পড়ার মতো হচ্ছে আর সে টেনে টেনে তুলছে। তার গায়ে রঙিন শার্ট। শার্টের একটা বোতাম নেই। বোতামের জায়গাটা সেফটি পিন দিয়ে আটকানো। ছেলেটা বাবলুর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে বলল, এই, তুই আমার সঙ্গে খেলবি?