আমার নিজের বইটা কেমন ? খুব জটিল নয় বলেই আমার ধারণা। সরল ভাষায় বইটি লেখা। যে কেউ পড়েই বুঝতে পারবে। কিন্তু সত্যি কি পারবে? সারল্যের ভেতরেও তাে থাকে ভয়াবহ জটিলতা। যেখানে আমি নিজেই নিজেকে বুঝতে পারি না সেখানে বাইরের কেউ আমাকে কি করে বুঝবে? আমার নিজের অনেকটাই আমার কাছে অজানা। কিছু কিছু কাজ আমি করি কেন করি নিজেই জানি না। অন্য কেউ আমাকে দিয়ে করিয়ে নেয় বলে মাঝে মাঝে মনে হয়। আমার এই স্বীকারোক্তি থেকে কেউ মনে না করেন যে, আমি আমার কর্মকাণ্ডের দায়-দায়িত্ব অন্য কোন অজানা শক্তির উপর ফেলে দেবার চেষ্টা করছি। আমি ভাল করেই জানি, আমার প্রতিটি কর্ম কাণ্ডের দায়দায়িত্ব আমার। অন্যের নয়।
লেখালেখির ব্যাপারটাই ধরা যাক। অনেকবার আমার মনে হয়েছে, লেখালেখির পুরো ব্যাপারটা আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। নিয়ন্ত্রণ করছে অন্য কেউ। যার নিয়ন্ত্রণ কঠিন। যে নিয়ন্ত্রণের আওতা থেকে বের হওয়ার কোন ক্ষমতা আমার নেই । নিজের একটা লেখা থেকে উদাহরণ দেই – ‘কৃষ্ণপক্ষ।’ মিষ্টি প্রেমের উপন্যাস লিখবো – এই ভেবে শুরু করলাম। শুরুটা হল এই ভাবে “নােটটা বদলাইয়া দেন আফা, ছিড়া নোট।”
প্রথম বাক্যটি লিখেই পুরাে গল্প মাথায় সাজিয়ে নিলাম। সমস্যা দেখা দিল তখন। দ্বিতীয় বাক্যটি আর লিখতে পারি না। কত পৃষ্ঠা যে নষ্ট করলাম। প্রতিটিতে একটা বাক্য লেখা – “নোটটা বদলাইয়া দেন আফা, ছিড়া নােট।” বাসার সবাই অস্থির – হচ্ছে কি এসব? তাদের চেয়েও বেশি অস্থির আমি। পুরাে গল্প আমি সাজিয়ে বসে আছি, অথচ লিখতে পারছি না। এ কী যন্ত্রণা। শেষে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ঠিক করুলাম, যা হবার হবে। আগে থেকে ঠিকঠাক করা গল্প লিখবো না। যা আসে আসুক।
শুরু হল লেখা। পাতার পর পাতা লেখা হতে লাগল। এমন এক গল্প । আনি লিখতে চাই নি। উপন্যাসের নায়কের ভাগ্য যেন পূর্ব-নির্ধারিত। লেখক হিসেবে তা বদলানাের কোন রকম ক্ষমতা আমাকে দেয়া হয়নি। আমি একজন কপিরাইটার। কপি করছি, এর বেশি কিছু না। কে করাচ্ছে কপি? আমার ডিএনএ অণু, না অন্য কিছু? আমি জানি না। মাঝে মাঝে এই ভেবে কষ্ট পাই – নিজের সম্পর্কে আমরা এত কম জানি কেন? প্রকৃতি কি চায় না আমরা নিজেকে জানি?
এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা বলি। সন্ধ্যা থেকেই কাজ করছি। খাটের পাশে।ছােট্ট টেবিল নিয়ে মাথা গুজে লিখে যাচ্ছি। এক মুহূর্তের জন্যেও মাথা তুলছি না। হঠাৎ কি যেন হল। মনে হল কিছু একটা হয়েছে। অদ্ভুত কিছু ঘটে গেছে। বিরাট কোন ঘটনা, আর আমি তাতে অংশগ্রহণ না করে বােকার মত মাথা গুজে লিখে যাচ্ছি। লেখার খাতা বন্ধ করে উঠে পড়লাম, কিন্তু বুঝতে পারলাম না ব্যাপারটা কি। অস্থিরতা খুব বাড়লো। একবার মনে হল, এইসব মাথা খারাপের পূর্ব লক্ষণ। মাথা খারাপের আগে আগে নিশ্চয়ই মানুষের এমন ভয়ংকর অস্থিৰতা হয়। বারান্দায় এসে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে অস্থিরতার কারণ স্পষ্ট হল – আজ পূর্ণিমা। আকাশভরা জোছনা। প্রকৃতির এই অসাধারণ সৌন্দর্য উপেক্ষা করে আমি কি-না ঘরের অন্ধকার কোণে বসে আছি?
অনেকেই বলবেন, এটা এমন কোন অস্বাভাবিক ঘটনা না। যেহেতু জোছনা আমার প্রিয়, আমার অবচেতন মন খেয়াল রাখছে কবে জোছনা। সেই অবচেতন মনই মনে করিয়ে দিচ্ছে। আর কিছু নয়। অবচেতন মনের উপর দিয়ে অনেক কিছু আমরা পার করে দেই। ডাক্তারদের যেমন ‘এলার্জি’, মনােবিজ্ঞানীদের তেমনি ‘অবচেতন মন’। যখন রােগ ধরতে পারেন না তখন ডাক্তাররা গম্ভীর মুখে বলেন ‘এলার্জি’, মনােবিজ্ঞানী যখন সমস্যা ধরতে পারেন না, তখন বিজ্ঞের মত মাথা ঝাঁকিয়ে বলেন – ‘অবচেতন মনের কারসাজি। আর কিছুই না।’
সেই অবচেতন মনটাই বা কি? কতটুক তার ক্ষমতা? লেখকদের লেখালেখি কি অবচেতন মন নামক সমুদ্রে ভেসে উঠে? সেখান থেকে চলে আসে চেতন জগতে? ইপ্রিয় অগ্রাহ্য জগত থেকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে তার আগমন ? সেই ইন্দ্রীয় অগ্রাহ্য জগতটি আমার জানতে ইচ্ছে করে, বুঝতে ইচ্ছে করে।
অনার্স ক্লাসে আমি কোয়ান্টাম বলবিদ্যা পড়াই। আমাকে পড়াতে হয় ভাবনার হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা সূত্র। আমি বলি শােন ছেলেমেয়ে, কোন বস্তুর অবস্থান ও গতি একই সময়ে নির্ণয় করা যায় না! এই দুয়ের ভেতর সবসময় থাকে এক অনিশ্চয়তা। তুমি অবস্থান পুবােপুরি জানলে গতিতে অনিশ্চয়তা চলে আসবে। আবার গতি জানলে অনিশ্চয়তা চলে আসবে অবস্থানে। ছাত্ররা প্রশ্ন করে, “স্যার কেন?”
আমি নির্বিকার থাকার চেষ্টা করতে করতে বলি – এটা প্রকৃতির বেঁধে দেয়া নিয়ম। প্রতি চায় না আমরা গতি ও অবস্থান ঠিকঠাক জানি। জ্ঞানের অনেকখানি। প্রকৃতি নিজের কাছে রেখে দেয়। প্রকাশ করে না।
“কেন স্যার?”
“জানি না।”
কোয়ান্টাম বলবিদ্যার শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের অনেক প্রশ্নের উত্তরে আমাকে বলতে হয় -“জানি না।” জ্ঞানের তীব্র পিপাসা দিয়ে মানুষকে যিনি পঠিয়েছেন তিনিই আবার জ্ঞানের একটি অংশ মানুষের কাছ থেকে সরিয়ে রেখেছেন।
“কেনো?”
“উত্তর জানা নেই।”
এই মহাবিশ্বের বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তরই আমাদের জানা নেই। আমরা জানতে চেষ্টা করছি। যতই জানছি ততই বিচলিত হচ্ছি। আরো নতুন সব প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। বিজ্ঞানীরা নিদারুণ আতঙ্কের সঙ্গে লক্ষ্য করছেন তাদের সামনে কঠিন কালাে পর্দা। যা কোনদিনই উঠানাে সম্ভব হবে না। কি আছে এই পর্দার আড়ালে তা জানা যাবে না। আমার যাবতীয় রচনায় আমি ঐ কালে পর্দাটির প্রতি ইংগিত করি। আমি জানি না আমার পাঠক-পাঠিকারা সেই ইংগিত কি ধরতে পারেন, নাকি তার গল্প পড়েই তৃপ্তি পান। উদাহরণ দেই।