সে উঠে চলে গেল। রান্নাঘরে বাতি জ্বললো। কিছুদূর লিখলাম। না, ভাল হচ্ছে না। মতিকে আমি নিজে যে ভাবে দেখছি সেভাবে লিখতে পারছি না। নিজের উপর রাগ লাগছে, সেই সঙ্গে আশেপাশের সবার উপর রাগ লাগছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মনে হল, পৃথিবীর কুৎসিততম চায়ে চুমুক দিলাম। না হয়েছে লিকার, না হয়েছে মিষ্টি। নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম, “এটা কি বানিয়েছো?”
ছোট ছেলে নুহাশের ঘুম ভেঙে গেছে। ঘুম ভাঙলেই সে খানিকক্ষণ কাঁদে। সে কাদছে। আমি বিরক্ত হয়ে গুলতেকিনকে বললাম, “দাড়িয়ে দেখছো কি? কান্নাটা থামাও না।”
গুলতেকিন কান্না থামাতে গেল। সে কান্না থামাতে পারছে না। কান্না আরাে বাড়ছে। কাঁদতে কাঁদতেই নুহাশ দু’বার ডাকলো, “বাবা! বাবা!” সে নতুন কথা শিখেছে। কি সুন্দর লাগে তার কথা ! আমার উচিত উঠে গিয়ে তাকে কোলে নিয়ে আদর করা। ইচ্ছা করছে না। বরং রাগে শরীর জ্বলছে। মনে হচ্ছে, এরা সবাই মিলে প্রাণপণ চেষ্টা করছে যেন আমি লিখতে না পারি। আমি ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত গলায় বললাম, “সামান্য একটা কান্নাও থামাতে পারছো না। তুমি কি করো ?”
গুলতেকিন ছেলে কেলে নিয়ে দরজা খুলে বাইরে যাচ্ছে। খােলা বারান্দায় খানিকক্ষণ হাঁটবে। নুহাশ আমাকে দেখে আবারও কাঁদতে কাঁদতে ডাকলো, “বাবা, বাবা!” আমি বিচলিত হলাম না। আমার সামনে মতি। কিছুক্ষণের মধ্যে মতির চোখ উপড়ে ফেলা হবে। এমন ভয়াবহ সময়ে ছেলের কান্না কোন ব্যাপারই না। বাচ্চার অকারণেই কাদে। আবার অকারণেই তাদের কান্না থেমে যায়। এর কান্না থামবে। এর দুঃখের অবসান হবে কিন্তু মতি মিয়ার কি হবে ।
ছেলের কান্না থেমেছে। সে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার মা তাকে বিছানায় শুইয়ে নিজে মাথার কাছে মূর্তির মত বসে আছে। আমার এখন খারাপ লাগতে শুরু করেছে। আমার মনে পড়েছে, নুহাশের সকাল থেকে জ্বর। তার মা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছেলো। আমি নিয়ে যাইনি। ডাক্তারের চেম্বারে তিন ঘণ্টা বসে থেকে নষ্ট করার মত সময় আমার নেই। তা ছাড়া অসুখ-বিসুখ আমার ভাল লাগে না। একগাদা রােগীর মাঝখানে বসে থাকা ! হাতে নম্বর ধরিয়ে দেয়া বিয়াল্লিশ। ডাক্তার সাহেব দেখছেন সাত নাম্বার। কখন বিয়াল্লিশ আসবে কে জানে?
ডাক্তার নিয়ে যা করার গুলতেকিন করবে। আমি এর মধ্যে নেই। বাজারে যেতে হবে? নােংরা মাছ বাজারে থলি হাতে ঘােরা এবং প্রতিটি আইটেমে ঠকে আসা আমাকে দিয়ে হবে না। সেও গুলতেকিনের ডিপার্টমেন্ট। বাচ্চা কাচ্চাদের পড়াশােনা দেখা ? অসম্ভব ব্যাপার। নিজের পড়া নিয়েই কুল পাচ্ছি না। এদের পড়া কখন দেখব? যা হবার হবে। সংসার জলে ভেসে যাচ্ছে? যাক ভেসে।
খুব স্বার্থপরের মত কথা। আমি অবশ্যই স্বার্থপর। নিজেরটাই দেখি – আর কিছু না। টিভিতে নাটক চলছে আমার সমস্ত মমত নাটকের জন্যে। রেকর্ডিং থেকে রাত বারটা-একটায় ফিরি। কোন রকম ক্লান্তি বােধ করি না। বাসার সবাই যে না খেয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে তা আমার চোখে পড়ে না। নাটক ছাড়া তখন মাথায় আর কিছুই ঢুকে না। এই মুহুর্তে নটিক ছাড়া আমার ভুবনে আর কিছু নেই।
মেয়ের জন্মদিন হবে। সে তার সব বান্ধবীকে দাওয়াত দিয়েছে। না, আমি তাে থাকতে পারবো না। নাটকের রিহার্সেল আছে। জন্মদিন প্রতি বছর একবার করে আসবে। রিহার্সেল তাে প্রতি বছর একবার করে আসবে না। এরা বুঝতে পারে না – নাটকের রিহার্সেল আমার জন্যে এত জরুরি কেন। আমি বুঝতে পারি না জন্মদিন ওদের এত জরুরি কেন? ক্রমে ক্রমেই আমরা দূরে সরে যাই। আমরা ব্যথিত হই। সেই ব্যথা কেউ কাউকে বুঝাতে পারি না।
অন্যসব ছেলেদের মত আমারও ইচ্ছা ছিল নিজেকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবো। অন্য দশজনের মত হলে আমার চলবে না। আমাকে আলাদা হতে হবে চারপাশের মানুষদের মধ্যে যা কিছু ভাল গুণ দেখেছি তাই নিজের মধ্যে আনার চেষ্টা করেছি – চেষ্টা পর্যন্তই, লাভ কিছু হয়নি। মানুষ পরিবেশ দিয়ে পরিচালিত হয় না, মানুষের চালিকাশক্তি তার ডি এন এ। যা সে জন্মসূত্রে নিয়ে এসেছে। তার চারপাশের জগৎ তাকে সামান্যই প্রভাবিত করে। আমি আমার ডি এন এ অণুর গঠন কি জানি না। আমাদের জ্ঞান সেই পর্যন্ত পৌছেনি। একদিন পৌছবে, তখন সবার ডি এন এ অণুর প্রিন্টআউট তাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হবে। তা দেখেই সে বুঝবে সে কেমন। অন্যরাও বুঝবে। সব রকম অস্পষ্টতার অবসান হবে।
মায়েরা তখন বাচ্চার রেজাল্ট কেন খারাপ হয়েছে এ নিয়ে বাচ্চাকে বকা-ঝকা করবেন না, কারণ তারা ডি এন এ প্রিন্ট আউট দেখেই বুঝবেন এ পরীক্ষায় কখনােই তেমন ভাল করবে না। প্রতিদিন একটা করে প্রাইভেট টিউটর খুলে খাইয়ে দিলেও লাভ হবে না। সেই সময় একটি শিশুর জন্মের পর পরই সবাই জানবে, বড় হয়ে এ হবে অন্যদের চয়ে একটু আলাদা। সে জােছনা দেখলে অভিভূত হবে, বৃষ্টি দেখলে অভিভূত হবে, সারাক্ষণ তার মাথায় খেলা করবে অন্য এক বােধ।
ব্যাপারটা হয়তো খুব সুখকর হবে না, কারণ তখন মানুষের ভেতর রহস্য বলে কিছু থাকবে না। একজন অন্য একজনকে পড়ে ফেলবে খেলা বইয়ের মত। মানুষের সবচেয়ে বড় অহংকার হল, সে বই নয়। তাকে কখনাে পড়া যায় না। তারপরেও মানুষকে বই ভাবতে আমার ভাল লাগে। একেকজন মানুষ যেন একেকটা বই। কোন বই সহজ তড়তড় করে পড়া যায়। কোন বই অসম্ভব জটিল। আবার কোন কোন বইয়ের হরফ অজানা। সেই বই পড়তে হলে আগে হরফ বুঝতে হবে। আবার কিছু কিছু বই আছে যার পাতাগুলি শাদা। কিছু সেখানে লেখা নেই। বড়ই রহস্যময় সে বই।