আমার মেয়ের দুধ খাওয়ার গল্পটা বলি তার কাছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে অপছন্দের খাবার হল দুধ। দুধের বদলে তাকে বিষ খেতে দেয়া হলেও সে হাসিমুখে খেয়ে ফেলবে। সেই ভয়াবহ পানীয় তাকে রােজ বিকেলে এক গ্লাস করে খেতে হয়। আমি আমার কন্যার কষ্ট দেখে, এক বিকেলে তার দুধ চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেললাম! তাকে বললাম, মাকে বলিস না আমি খেয়েছি। এরপর থেকে রােজ তার দুধ খেতে হয়। এক সময় নিজের কাছেও অসহ্য বােধ হল। তখন দু’জন মিলে মুক্তি করে বেসিনে ফেলে দিতে লাগলাম। বেশিদিন চালানাে গেল না। ধরা পড়ে গেলাম।
বাবা হিসেবে আমি যা করেছি তা আদর্শ বাবার কাজ না। তবে শিশুদের পছন্দের বাবার কাজ তাে বটেই। গুলতেকিন আমার কন্যার দুধের গল্প মনে করায় আমার উদ্বেগ দূর হল। আমি মােটামুটি নিশ্চিত হয়েই ঘুমুতে গেলাম। যাক, আমি খারাপ বাবা নই একজন ভাল বাবা। তবু সন্দেহ যায় না।
পরদিন ছােটমেয়ে বিপাশাকে আইসক্রীম খাওয়াতে নিয়ে গেলাম। সে বিস্মিত, তাকে একা নিয়ে যাচ্ছি। অন্য কাউকে নিচ্ছি না। ব্যাপারটা কি ?
তাকে ডলসি ভিটায় কোন আইসক্রীম কিনে ফিস ফিস করে বললাম, “আচ্ছা মা বল তাে, কাকে তােমার বেশি পছন্দ ? তােমার মা’কে, না আমাকে?”
সে মুখভর্তি আইসক্রীম নিয়ে বললো, “তােমাকে”।
তার বলার ভঙ্গি থেকে আমার সন্দেহ হল। আমি বললাম, “তােমার মা শিখিয়ে দিয়েছে এরকম বলার জন্যে, তাই না?”
“হুঁ।”
“সে আর কি বলেছে ?”
“বলেছে–বাবা যদি তােমাদের জিজ্ঞেস করে কে সবচেয়ে প্রিয় তাহলে আমার নাম বলবে না, তােমার বাবার নাম বলবে। না বললে সে মনে কষ্ট পাবে। লেখকদের মনে কষ্ট দিতে নেই।”
সত্যকে এড়ানাে যায় না, পাশ কাটানাে যায় না। সত্যকে স্বীকার করে নিতে হয়। আমি স্বীকার করে নিলাম। নিজেকে বুঝালাম – আমার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা যে কোন ব্যস্ত বাবার ক্ষেত্রেই ঘটবে। একদিন এই ব্যস্ত বাবা অবাক হয়ে দেখবেন এই সংসারে তার কোন স্থান নেই। তিনি সংসারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। সংসারও তার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। এই এক আশ্চর্য খেলা।
এই খেলা আমাকে নিয়েও শুরু হয়েছে। আমি একা হতে শুরু হতে করেছি। বন্ধু-বান্ধব কখনােই তেমন ছিল না। এখন আরো নেই। যারা আসেন কাজ নিয়ে আসেন। কাজ শেষ হয়, সম্পর্কও ফিকে হতে শুরু করে। পুরানাে বন্ধুদের কেউ কেউ আসেন তখন হয়তো লিখতে বসেছি। লেখা ছেড়ে উঠে আসতে মায়া লাগছে। তবু এলাম। গল্প জমাতে পারছি না। সারাক্ষণ মাথায় ঘুরছে – এরা কখন যাবে? এরা কখন যাবে? এরা এখনো যাচ্ছে না কেন?
যে আন্তরিকতা, যে আবেগ নিয়ে তারা এসেছেন আমি তা ফেরত দিতে পারলাম না। তারা মন খারাপ করে চলে গেলেন। আমিও মন খারাপ করেই লিখতে বসলাম। কিন্তু সুর কেটে গেছে। লেখার সঙ্গে আর যােগসূত্র তৈরি হচ্ছে না। যে চরিত্ররা হাতের কাছে ছিল তারা দূরে সরে গেছে। তবু তাদের আনতে চেষ্টা করছি। অনেক কষ্টে কয়েক পৃষ্ঠা লেখা হল। ভাল লাগলো না। ছিড়ে কুচি কুচি করে ঘুমুতে গেলাম! মাথা দপ দপ করছে, ঘুম আসছে না। চা খেলে হয়ত ভালো লাগবে। গভীর রাতে কে চা বানিয়ে দেবে? রান্নাঘরে গিয়ে নিজেই খুটখাট করছি । গুলতেকিন এসে দাঁড়াল। ঘুম ঘুম চোখে বললো, “তুমি বারুদায় বস, আমি চা বানিয়ে আনছি।”
সে শুধু আমার জন্যে চা আনলো না, নিজের জন্যেও আনলো। আটতলা ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে দুজনে চুক চুক করে চা খাচ্ছি। আমি খানিকটা লজ্জিত বােধ করছি। আমার কারণে এত রাতে গুলতেকিনকে উঠতে হল। লজ্জা কাটানোর জন্যে অকারণেই বললাম, “চা খুব ভাল হয়েছে। একসেলেন্ট।
সে কিছু বললো না।
আমি বললাম, “একটা লেখা মাথায় চেপে বসে আছে, নামাতে পারছি না। কি করি বল তাে?”
সে হালকা গলায় বলল, “লাঠি দিয়ে তােমার মাথায় একটা বাড়ি দেই, তাতে যদি নামে তাে নামলো। না নামলে কি আর করা।”
আমরা দুজনেই হেসে উঠলাম। এতে টেনশন খানিকটা কমল। আমি বললাম, “গল্পটা কি শুনতে চাও?”
“বল।”
আমি বুঝতে পারছি তার শােনার তেমন আগ্রহ নেই। সারাদিনের পরিশ্রমে সে ক্লান্ত। ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তারপরেও আমাকে খুশি করার জন্যে জেগে থাকা। আমি প্রবল উৎসাহে গল্পটা বলতে শুরু করেছি–
— “মতি নামের একটা লোক। তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। গ্রামের লােকজন মিলে ঠিক করেছে খেজুরের কাঁটা দিয়ে তার দুটা চোখই উপড়ে ফেলা হবে।”
— “মতির চোখ তােলা হবে কেন? সে কি করেছে ?”
— “এখনাে ঠিক করিনি সে কি করেছে। তবে গ্রামবাসীর চোখে সে অপরাধী তাে বটেই, নয়ত তার চোখ তােলা হবে কেন? তাকে ভয়ংকর কোন অপরাধী হিসেবে আমি দেখাতে চাই না। ভয়ংকর অপরাধী হিসেবে দেখালে আমার পারপাস সার্ভড হবে না।”
— “তোমার পারপাসটা কি?”
— “চোখ তােলার ব্যাপারটা যে কি পরিমাণ অমানবিক সেটা তুলে ধরা। এমনভাবে গল্পটা লিখবো যেন যেন ”
— “যেন কি ?”
— “তোমাকে ঠিক বুঝতে পারছি না। মানে ব্যাপারই হল কি ”
গুলতেকিনকে বলতে বলতে গল্প লেখার আগ্রহ আর বোধ করতে লাগলাম। আমার মনে হতে লাগল, এক্ষুণি লিখে ফেলতে হবে। এক্ষুণি না লিখলে আর লিখতে পারব না। আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে বারান্দায় বসে আছি। আকাশে এক ফালি চাদও আছে। বারান্দায় সুন্দর জোছনা। অথচ এই জোছনায় আমি গুলতেকিনকে দেখছি না। দেখছি তার জায়গায় মতি মিয়া বসে আছে। তাকে দড়ি দিয়ে বাধা হয়েছে। সে অসহায়ভাবে তাকাচ্ছে আমার দিকে। চোখের দৃষ্টিতে বলছে – “আমার ঘটনাটা লিখে ফেললে হয় না? কেন দেরি করছেন?”
আমি ক্ষীণ গলায় ডাকলাম, “গুলতেকিন।”
“কী?”
“ইয়ে, তুমি কি আরেক কাপ চা বানিয়ে দিতে পারবে?”
“শুবে না?”
“না, মানে ভাবছি গল্পটা শেষ করেই ঘুমুতে যাই।”
“সকালে লিখলে হয় না?”
“উহু”।