ঈদের নামাজ পড়লাম নিউ মার্কেটের মসজিদে। ফিরবার পথে দেখি আজিমপুর কবরস্থানের গেট খুলে দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ সেখানে। একজন বাবা তার তিনটি ছেলেমেয়ে নিয়ে কবরস্থানে এসেছেন। ছেলেমেয়েদের গায়ে ঝলমলে পোশাক। ওরা একটি কবরের পাশে গোল হয়ে পঁড়িয়ে আছে। কবরটির উপরে একটি ময়লা কাগজ পড়ে ছিলো। বড় মেয়েটি সে কাগজটি তুলে ফেলে গভীর মমতায় কবরের গায়ে হাত রাখলো। বাবাকে দেখলাম রুমাল বের করে চোখ মুছছেন। এটি কার কবর? বাচ্চাগুলির মার? আজকের এই আনন্দের দিনে এই মা ফিনি রান্না করেননি। গভীর মমতায় শিশুদের নতুন জামা পরিয়ে দেননি। নতুন শাড়ি পরে তিনি আজ আর লজ্জিত ভঙ্গিতে স্বামীর পাশে এসে দাঁড়ায়ে বলেননি–কি, তোমাকেও সালাম করতে হবে নাকি?
আসলে আমাদের সবচে’ দুঃখের দিনগুলিই হচ্ছে উৎসবের দিন।*
———-
* এই লেখাটা ঈদের লেখা হিসেবে দৈনিক বাংলায় ছাপা হয়। তার কিছুদিন পর আমার ছোট ছেলেটি মারা যায়। আমি অবিকল এই রচনাটির মত আমার তিনটি বাচ্চা এবং স্ত্রীকে নিয়ে ঈদের দিন আমার বাচ্চাটির কবর দেখতে যাই। আমার বাচ্চারা ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে থাকে…
এই আমি
আমার বড় মেয়ে তার কলেজে একটা কোয়েশ্চেনীয়ার জমা দেবে। সেখানে অনেকগুলি প্রশ্নের ভেতর একটা প্রশ্ন হচ্ছে – “তােমার প্রিয় ব্যক্তি কে?” সে লিখলো, ‘আমার মা’।
আমি ভেবেছিলাম সে লিখবে – বাবা।
আমার সব সময় ধারণা ছিল আমার ছেলেমেয়েরা আমাকে খুব পছন্দ করে। অন্তত তাদের মা’র চেয়ে বেশি তাে বটেই। করারই কথা, আমি কখনাে তাদের বকা-ঝকা করি না। অথচ তাদের মা এই কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করছে –
“বাথরুম ভেজা কেন?”
“সন্ধ্যা হয়ে গেছে, পড়তে বসনি। পড়তে বােস।”
“টুথপেস্টের মুখ লাগানো নেই, এর মানে কি?”
“বন্ধুর সঙ্গে এতক্ষণ টেলিফোনে কথা কেন?”
“ফ্রকে ময়লা কি ভাবে লাগলো?”
“মাছ তাে গোটাটাই ফেলে দিলে। বােন-প্লে থেকে তুলে এনে খাও। তােল বলছি। তােল।”
এই সব যন্ত্রণা আমি তাদের দেই না। খাবার টেবিলে আমি ওদের সঙ্গে মজার মজার গল্প করি। ভিডিও ক্লাবে কোন ভাল ছবি পাওয়া গেলে সবাইকে নিয়ে এক সঙ্গে দেখি। তারচেয়েও বড় কথা, এমন সব কাণ্ড-কারখানা মাঝে মাঝে করি যা বাচ্চাদের কল্পনাকে উজ্জীবিত করবেই। যেমন শহীদুল্লাহ হল-এ যখন থাকতাম তখন ভরা জোছনার রাতে বাচ্চাদের খুম থেকে তুলে পুকুরে গােসল করতে নিয়ে যেতাম। বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে সবাইকে নিয়ে পানিতে ভেজা তাে আমার চিরকালের নিয়ম। সব সময় করছি। যে মানুষটি এমন সব কাণ্ডকারখানা করে সে কেন প্রিয় হবে না? আমার বড় মেয়ের কোয়েশ্চেনীয়ার দেখে হঠাৎ করে আমার মনে হল আমি কি এদের কাছ থেকে দূরে সরে গেছি? যদি দূরে সরে গিয়ে থাকি তাহলে তা কখন ঘটলো ?
সারাদিন নানান কাজে ব্যস্ত থাকি। ইউনিভার্সিটির কাজ, নাটকের কাজ, লেখার কাজ। এর ফাকে ফাকে লোক আসছে। প্রকাশকরা আসছেন লেখার তাগাদা নিয়ে। এসেই চলে যাচ্ছেন না, বসছেন, গল্প করছেন। চা খাচ্ছেন। নাটকে অভিনয় করতে ইচ্ছুক তরুণ-তরুণীরা আসছে। যে ভাবেই হােক তাদের টিভি নাটকে সুযোগ দিতে হবে। আমার গল্প-উপন্যাস পড়ে খুশি হয়েছে এমন লােকজন আসছে। খুশি হয়নি এমন লােকজন আসছে। আসছে পত্রিকা অফিসের মানুষ। কেউ বুঝতে পারছে না, আমি ক্লান্ত ও বিরক্ত। আমার বিশ্রাম দরকার, নিরিবিলি দরকার। আমার অনেক দূরে কোথাও চলে যাওয়া দরকার। আমার সবটুকু সময় বাইরের লোজজন নিয়ে নিচ্ছে । আমার ছেলেমেয়েদের জন্যে, আমার স্ত্রীর জন্যে একটুও সময় আলাদা নেই।
একটা শট ফিল্ম বানাচ্ছি। সেই ছবির শ্যুটিং এর কারণে এক সপ্তাহের জন্যে বাইরে যেতে হল। যাবার আগ মুহূর্তেও লােকজন এসে উপস্থিত। তাদেরকে বিদেয় করতে করতে অনেক দেরি হয়ে গেল। ট্রেন মিস করব। ছুটে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম। ড্রাইভারকে বললাম, খুব স্পীডে চালাও। ড্রাইভার উল্কার গতিবেগে ছুটল। আর তখন মনে হল, আসার সময় বিদেয় নিয়ে আসা হয়নি। বাচ্চারা হয়ত মনে মনে অপেক্ষা করছে, রওনা হবার আগে আমি বলব – বাবারা, যাই কেমন? সেটা বলা হয়নি। তারা দেখছে অসম্ভব ব্যস্ত এক মানুষকে। একে তারা হয়তো ভালমত চেনেও না। একজন অতি-চেনা মানুষ এম্নি করেই আস্তে আস্তে অচেনা হয়ে যায়। সম্ভবত আমিও অচেনা হয়ে গেছি। তবু ক্ষীণ আশা নিয়ে একদিন মেঝে মেয়েকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গেলাম। গলা নিচু করে কথা বলছি যেন অন্য কেউ কিছু শুনতে না পায়।
“কেমন আছ গো মা?”
“খুব ভাল, না মোটামুটি ভাল?”
“খুব ভাল।”
“এখন বল দেখি তােমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ কে ?”
“কোন প্রিয় মানুষ নেই বাবা।”
“না থাকলেও তাে এমন মানুষ আছে যাদের তােমার ভাল লাগে। আছে না?”
“মা তোমার সবচেয়ে প্রিয়?”
“হু–মা।”
“আর কেউ আছে?”
“আর ছােট চাচী।”
“আর কেউ?”
“শাহীন চাচা।”
আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম লিস্ট লম্বা হচ্ছে – কিন্তু সেই দীর্ঘ লিস্টে আমার নাম নেই। আমাকে সে হিসেবের মধ্যেই আনছে না। এ রকম কেন হবে। দু’দিন আমি খুব চিন্তা করলাম। ভেবেছিলাম ব্যাপারটা নিজের মধ্যেই রাখবো। আমার স্ত্রী গুলতেকিনকে জানাব না। এক রাতে তাকেও বললাম। সে বললো, “কি অদ্ভুত কথা বলছো? বাচ্চারা তােমাকে অপছন্দ করবে কেন? তুমি ওদের খুবই প্রিয়।”
“তুমি আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে বলছো?”
“মােটেই না। আমার ধারণা তােমার মত ভালো বাবা কমই আছে।”
“সত্যি বলছো?”
“হ্যা সত্যি। শীলার দুধ খাওয়ার ব্যাপারটা মনে করো। ক’জন বাবা এরকম করবে? শীলার দুধ খাওয়ার কথা মনে আছে?”
“আছে।”