বুঝলি দোস্ত, ছেলেটা মারা যাবার পর আমার আসল সমস্যা শুরু হল। আমার রোখ চেপে গেল। ঠিক করলাম–যখন যেখানে অসুস্থ ছেলেপেলে দেখব, চিকিৎসা করাব। দেখি কি হয়। দেখি এরা বাঁচে না মরে। সেই থেকে শুরু।
রাস্তায় অসুখ-বিসুখে কাতর কাউকে দেখলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। টাক পয়সা সব এতেই চলে যায়।
তারপর বিয়ে করলাম। সংসার হল। অভ্যাসটা গেল না। চিকিৎসার খরচ আছে। আমি বেতনও তো তেমন কিছু পাই না। সংসারে টানাটানি লেগেই থাকে। বিয়ের সময় তোর ভাবী বেশ কিছু গয়না-টয়না পেয়েছিল। সব বেচে খেয়ে ফেলেছি। এই নিয়েও সংসারে অশান্তি। হা হা হা।
‘কতজন রোগী এই ভাবে সুস্থ করেছিস?’
‘অনেক।‘
‘আর কেউ মারা যায় নি?’
‘না। আর একজনও না। প্রথমজনই শুধু মারা গেল। আর কেউ না।‘
‘এই মুহূর্তে কারোর চিকিৎসা করছিস?”
‘হ্যাঁ, এখনো একজন আছে। জয়দেবপুরের এক মেয়ে। ঠোঁট কাটা। প্লাস্টিক সার্জারী করে ঠোঁট ঠিক করা হবে।‘
আমি মুগ্ধ গলায় বললাম, তুই যে কত বড় কাজ করছিস সেটা কি তুই জানিস?
সফিক অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বড় কাজ করছি, না ছোট কাজ করছি তা জানি না, তবে আমার একেকটা রোগী যেদিন সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে, সেদিন যে আমার কত আনন্দ হয় তা শুধু আমিই জানি। এই আনন্দের কোন তুলনা নেই। প্রতিবারই আমি আনন্দ সামলাতে না পেরে হাউমাউ করে কাদি। লোকজন, ডাক্তার, নার্স সবার সামনেই কাদি।
বলতে বলতে সফিকের চোখে পানি এসে গেল। পানি মুছে সে স্বাভাবিক গলায় বলল, তারপর দোস্ত, তোর খবর বল। তুই কেমন আছিস?
আমি মনে মনে বললাম, শারীরিকভাবে আমি ভাল আছি। কিন্তু আমার মনটা অসুস্থ হয়ে আছে–তুই আমার মন সুস্থ করে দে। এই ক্ষমতা অল্প কিছু সৌভাগ্যবানদের থাকে। তুই তাদের একজন।
উমেশ
উমেশের সঙ্গে আমার পরিচয় নর্থ ডাকোটার ফার্গো সিটিতে। মাদ্রাজের ছেলে। বানরের মত চেহারা। স্বভাব-চরিত্রও বানরের মত–সারাক্ষণ তিড়িং-বিড়িং করছে। গলা খাঁকারি দিয়ে থুথু ফেলছে। হাসেও বিচিত্র ভঙ্গিতে খিকখিক করে, থেমে থেমে শব্দ হয়, সমস্ত শরীর তখন বিশ্রীভাবে দুলতে থাকে।
সে এসেছে জৈব রসায়নে M.s. ডিগ্রী নিতে। আমি তখন পড়াশোনার পাট শেষ করে ফেলেছি। একটা ইলেকট্রিক টাইপ রাইটার কিনেছি, দিন-রাত খটখট শব্দে থিসিস টাইপ করি। একেকটা চ্যাপ্টার লেখা শেষ হয়, আমি আমার প্রফেসরের কাছে নিয়ে যাই। তিনি পড়েন এবং হাসিমুখে বলেন, অতি চমৎকার হয়েছে। তুমি এই। চ্যাপ্টারটা আবার লেখ।
আমি হতাশ হয়ে বলি, অতি চমৎকার হলে নতুন করে লেখার দরকার কি? প্রফেসরের মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হয়। তিনি বলেন, অতি চমৎকার তো শেষ কথা নয়। অতি চমৎকারের পরে আছে অতি, অতি চমৎকার। আমি তার জন্যে অপেক্ষা করছি।
আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আবার লিখতে বসি। এই সময়ে উমেশের আবির্ভাব হল মূর্তিমান উপদ্রবের মত। তার প্রধান কাজ হল ‘আবে ইয়ার’ বলে আমার ঘরে ঢুকে পড়া। এবং আমাকে বিরক্ত করা।
আমেরিকায় সে পড়াশোনা করার জন্যে আসেনি। তার মূল উদ্দেশ্য সিটিজেনশীপ। অন্য কোনভাবে আমেরিকা আসার ভিসা পাওয়া যাচ্ছিল না বলেই সে স্টুডেন্ট ভিসায় এসেছে। এখন তার দরকার–‘সবুজপত্র’ বা গ্রীনকার্ড। ঐ বস্তু কি করে পাওয়া যায় সেই পরামর্শ করতেই সে আমার কাছে আসে।
আমি প্রথম দিনেই তাকে বলে দিলাম, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। জানার আগ্রহও বোধ করিনি। আমি এসেছি পড়াশোনা করতে। ঐ পর্ব শেষ হয়েছে, এখন দেশে চলে যাব। উমেশ চোখ-মুখ কুঁচকে ‘আবে বুরবাক . . . ‘ শব্দ দুটি দিয়ে একগাদা কথা বলল, যার কিছুই আমি বুঝলাম না। হিন্দী আমি বুঝতে পারি না। তাছাড়া উমেশ কথা বলে দ্রুত। তবে তার মূল বক্তব্য ধরতে অসুবিধা হল না। মূল বক্তব্য হচ্ছে–হুমায়ূন, তুমি মহা বুরবাক। এমন সোনার দেশ ছেড়ে কেউ যায়?
কাজের সময় কেউ বিরক্ত করলে আমার অসহ্য বোধ হয়। এই কথা আমি উমেশকে বুঝিয়ে বললাম। সে বিস্মিত হয়ে বলল, আমি তো বিরক্ত করছি না। চুপচাপ বসে আছি। তুমি তোমার কাজ কর।
সে চুপচাপ মোটেও বসে থাকে না। সারাক্ষণ তিড়িং-বিড়িং করে। এই বসে আছে, এই লাফ দিয়ে উঠছে। তাছাড়া তার শিস দিয়ে গান গাওয়ার শখও আছে। সে শিস দিয়ে নানান ধরনের সুর তৈরির চেষ্টা করে। সেই সুরের তালে পা নিজেই মুগ্ধ। হয়ে নাচায়।
সব মানুষের জীবনেই কিছু উপগ্রহ জুটে যায়। উমেশ হল আমার উপগ্রহ। সে . জৈব রসায়নের তিনটা কোর্স নিয়েছে। এর মধ্যে একটা ল্যাব কোর্স। কাজ করে আমার ঘরের ঠিক সামনের ঘরে। কাজ বলতে জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করা, বোয়াধুয়ি … করা, তারপর আমার সামনে এসে বসে থাকা। পা নাচানো এবং শিস দেয়া। আমি তাকে বললাম, কোর্স যখন নিয়েছ মন দিয়ে কোর্সগুলি করা দরকার। তুমি তো সারাক্ষণ আমার সামনে বসেই থাক।
সে হাসিমুখে বলল, M.s. ডিগ্রীর আমার কোন শখ নেই। আমার দরকার। সিটিজেনশীপ। স্টুডেন্ট ভিসা যাতে বজায় থাকে এই জন্যেই কোর্স নিলাম। পড়াশোনা করে হবেটা কি ছাতা?
আমি বললাম, অনেক কিছুই হবে। একটা আমেরিকান ডিগ্রী পেলে এ দেশে চাকরি পেতে তোমার সুবিধা হবে। চাকরি পেলে গ্রীনকার্ড পাবে।
‘আবে ইয়ার–সাচ বাত।‘