কৃষ্ণপক্ষ উপন্যসের নায়ক মুহিবের বিয়ের দিন। একটা কটকটে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরে এসেছিল। সবাই তাই নিয়ে খুব হাসাহাসি করলো। ছেলেটি মারা গেল।বিয়ের পর দিন। তার স্ত্রী অরুর বিয়ে হল অন্য এক জায়গায়। কোটে গেল দীর্ঘ কুড়ি বছর। কুড়ি বছর পর সেই অরুর মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। বাড়িতে তুমুল উত্তেজনা। বর এসেছে, বর এসেছে। অরু আগ্রহ করে নিজেও তার কন্যার বর দেখতে গেলেন। ছেলেকে দেখেই তিনি চমকে উঠলেন। তার গায়েও কটকটে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি। যেন এই ছেলে কুড়ি বছর আগের মুহিবের পাঞ্জাবিটা পরে চলে এসেছে।
অনেকেই আমাকে বলেছেন, কৃষ্ণপক্ষ উপন্যাস থেকে হলুদ পাঞ্জাবির অংশটা বাদ দিলে উপন্যাসটা সুন্দর হত। উপন্যাসে এই অংশটুকুই দুর্বল। হিন্দী ছবির মত মেলোড্রামা। অথচ উপন্যাসটা লেখাই হয়েছে হলুদ পাঞ্জাবির ব্যাপারটির জন্যে। আমি কি আমার বােধ পাঠকদের কাছে ছড়িয়ে দিতে ব্যর্থ হচ্ছি? এরা হিমুর বাইরের রূপটি দেখে। তার উদ্ভট কাণ্ডকারখানায় মজা পায় কিন্তু এর বাইরেও তো হিমুর অনেক কিছু বলার আছে। হিমু ক্রমাগত বলেও যাচ্ছে । কেন কেউ এ ধরতে পারছে না? লেখক হিসেবে এরচেয়ে বড় ব্যর্থতা আবে কি হতে পারে ?
আমি আমার গল্পটা লিখে শেষ করেছি। মতির চোখ উপড়ে ফেলার গল্প। সাধারণত গল্পগুলি আমি গভীর রাতে শেষ করি। এই প্রথম শেষ করলাম বিকেলে। আনন্দে চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে শােবার ঘরে এসে দেখি, আমার মেয়েরা সবাই সাজ-পােশাক পরছে। একেকজনকে পরীর মত দেখাচ্ছে।
— আমি বললাম, “ব্যাপার কি ?”
— ওরা ঝলমল করতে করতে বললো, “তুমি কাপড় পরে নাও। দেরি করছ কেন? আমরা বিয়েতে যাব না?”
— ওদের মা বললো, “তাের বাবার চোখ দেখে বুঝতে পারছিস না, সে যাবে না? সে ঘরে চুপচাপ একা একা বসে থাকবে।”
— বড় মেয়ে দুঃখীত গলায় বললো, “বাবা তুমি যাবে না?”
— আমি বললাম, “অবশ্যই যাব। কে বলেছে যাব না?”
শার্ট-প্যান্ট ইস্ত্রি করা নিয়ে অতিরিক্ত রকম ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বিয়েবাড়িতেও সবার সঙ্গে খুব হৈ-চৈ করলাম। গল্পগুজব, রসিকতা। সবাই ভাবলো, বাহ লােকটা বেশ মজার তো। কেউ আমার নিঃসঙ্গতা বুঝতে পারলো না। শুধু এক ফাকে গুলতেকিন এসে বললো, “তোমার কি হয়েছে?” আমি জবাব দিলাম না। আমার কি হয়েছে আমি নিজেই কি ছাই জানি? শুধু জানি, মতি মিয়ার গল্প লিখে শেষ করেছি। মতি মিয়া এখন আর আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কাতর অনুনয় করবে না – ‘স্যার, আমার ব্যাপারটা লিখে ফেলুন।’
জীবনের গভীরতম ব্যাথাকে আমি অনুভব করতে পারি। জোছনার অপূর্ব ফুলকে আমি দেখতে পাই – কিন্তু তারা অন্তরের এতই গভীরে যে, আমি তুলে আনতে পারি না। বার বার হাত ফসকে যায়। দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী জেগে আমি অপেক্ষা করি। কোন দিন কি পারবো সেই মহান বােধকে স্পর্শ করতে? নিজেকে বােঝাই – ভাগ্যে যা আছে তা হবে।
Every man’s fate
We have fastened
On his own neck
(সুরা বনি ইস্রায়িল)
আমরা কি করবো, না করবো সবই পূর্ব নির্ধারিত। কি হবে চিন্তা করে ? নিয়তির হাতে সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে অপেক্ষা করাই ভাল।
আমি অপেক্ষা করি।
চান্নি পসর রাইত
আলাউদ্দিন নামে আমার নানাজানের একজন কামলা ছিল। তাকে ডাকা হত আলাদ্দি। কামলা শ্রেণীর লোকদের পুরো নামে ডাকার চল ছিল না। পুরো নাম ভদ্রলোকদের জন্যে। এদের আবার নাম কি? একটা কিছু ডাকলেই হল। ‘আলাদ্দি’ যে ডাকা হচ্ছে এই-ই যথেষ্ট।
আলাউদ্দিনের গায়ের রঙ ছিল কুচকুচে কালো। এমন ঘন কৃষ্ণবর্ণ সচরাচর দেখা যায় না। মাথাভর্তি ছিল বাবরি চুল। তার চুলের যত্ন ছিল দেখার মত। জবজবে করে তেল মেখে মাথাটাকে সে চকচকে রাখতো। আমাকে সে একবার কানে কানে বলল, বুঝলা ভাইগ্না ব্যাটা, মানুষের পরিচয় হইল চুলে। যার চুল ঠিক তার সব ঠিক।
কামলাদের মধ্যে আলাউদ্দিন ছিল মহা ফাঁকিবাজ। কোন কাজে তাকে পাওয়া যেত না। শীতের সময় গ্রামে যখন যাত্রা বা গানের দল আসতো তখন সে অবধারিতভাবে গানের দলের সঙ্গে চলে যেত। মাসখানিকতার আর কোন খোঁজ পাওয়া যেত না। অথচ শীতের মরশুম হচ্ছে আসল কাজের সময়। এমন ফাঁকিবাজকে কেউ জেনে-শুনে কামলা নেবে না। নানাজান নিতেন, কারণ তাঁর উপায় ছিল না। আলাউদ্দিন বৈশাখ মাসের শুরুতে পরিষ্কার জামাকাপড় পরে চোখে সুরমা দিয়ে উপস্থিত হত। নানাজানের পা ছুঁয়ে সালাম করে তৃপ্ত গলায় বলতো, মামুজী, দাখিল হইলাম।
নানাজান চেঁচিয়ে বলতেন, যা হারামজাদা, ভাগ।
আলাউদ্দিন উদাস গলায় বলতো, ভাইগ্যা যামু কই? আল্লাপাক কি আমার যাওনের জায়গা রাখছে? রাখে নাই। তার উপরে একটা নয়ন নাই। নয়ন দুইটা ঠিক থাকলে হাঁটা দিতাম। অফমান আর সহ্য হয় না।
এর উপর কথা চলে না। তাকে আবারো এক বছরের জন্যে রাখা হত। বারবার সাবধান করে দেয়া হত যেন গানের দলের সঙ্গে পালিয়ে না যায়। সে আল্লার নামে, পাক কোরানের নামে, নবীজীর নামে কসম কাটতো–আর যাবে না।
‘মামুজী, আর যদি যাই তাইলে আপনের গু খাই।‘
সবই কথার কথা। গানের দলের সঙ্গে তার গৃহত্যাগ ছিল নিয়তির মতো। ফেরানোর উপায় নেই। নানাজান তা ভালমতই জানতেন। বড় সংসারে অকর্মা কিছু লোক থাকেই। এদের উপদ্রব সহ্য করতেই হয়।