আজ সে সেই ঘরটা পেল।
সকাল থেকেই মা ঘর সাজাচ্ছেন। নাবিল একবার বলেছে, মা তোমার হেল্প লাগবে? হেল্প হল একটা ইংরেজি শব্দ। হেল্পের মানে সাহায্য। নাবিল স্কুলে অনেক ইংরেজি শব্দ শিখেছে। মা বলেছেন, হেল্প লাগবে না ব্যাটা।
মা তাকে সবসময় আদর করে ব্যাটা বলেন। ব্যাটা মানে হচ্ছে লোক। তবে ছোট বাচ্চাদের ব্যাটা বললে সেটার অর্থ লোক হয় না। সেটার অর্থ হয় আদরের চাঁদসোনা, লক্ষ্মীসোনা, পুটুস পুটুস।
ঘরটা এত সুন্দর করে সাজানো হল যে নাবিলের প্রায় কান্না পেয়ে যেতে লাগল। সে কেঁদেই ফেলত। কিন্তু ছেলেদের কাঁদতে নেই বলে কাঁদল না। ছোট মেয়েদের কাঁদলে অবশ্যি তেমন দোষ নেই। নাবিলের ছোটবোনের নাম এশা। সে খুব কাঁদে। মা যদি হাসি মুখে নাবিলকে কিছু বলেন তাতেও সে কাঁদবে। ঠোঁট বাঁকিয়ে নাকিসুরে বলবে ‘কেন তুমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে হাসলে এ্যাঁ এ্যাঁ এ্যাঁ।’
বাবা প্রায়ই বলেন, এশা আসলে পেত্নীদের ছানা। তারা ভুল করে আমাদের বাসায় রেখে গেছে। পেত্নীরা নাকে কথা বলে বলেই এশাও রেগে গেলে নাকে কথা বলে। এগুলি অবশ্যি বাবার বানানো কথা। বড়রা খুব বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে।
ঘর সাজানো হয়ে যাবার পর নাবিলের মা বললেন, ‘তারপর ব্যাটা, একা একা যে ঘুমোবে, ভয় পাবে নাতো?’
নাবিল বলল, ‘না।‘
‘ভয় পাবার কিছু নেই। আমরাতো পাশের ঘরেই আছি। তোমার দরজা থাকবে খোলা। আমাদের দরজাও থাকবে ভোলা। ভয় পেলে ডাকবে।‘
‘আমি ভয় পাব না মা।‘
‘তোমার কি ঘর পছন্দ হয়েছে ব্যাটা?
‘হ্যাঁ।‘
‘বেশি পছন্দ হয়েছে না অল্প পছন্দ হয়েছে?’
‘বেশি পছন্দ হয়েছে মা। এত বেশি পছন্দ হয়েছে যে আমার কেঁদে ফেলতে ইচ্ছা করছে।
মা হেসে ফেললেন। মাকে হাসতে দেখে এশা রেগে গিয়ে বলল, ‘মা, তুঁমি ভাঁইয়ার দিকে তাঁকিয়ে হাঁসবে নাঁ। আঁমার দিঁকে তাঁকিয়ে হাস।’
মা তখন এশার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
রাতে বাবা তাকে ঘরে শুইয়ে দিতে এলেন। মা এশাকে গল্প করে ঘুম পাড়াচ্ছেনতো তাই তিনি আসতে পারলেন না।
বাবা নাবিলের গলা পর্যন্ত চাদর টেনে দিলেন। কপালে চুমু দিলেন। তারপর চুলে আঙুল দিয়ে বিলি দিতে দিতে বললেন, কী কাণ্ড, আমার ছেলেটা এত বড় হয়ে গেছে। একা একা নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছে। তার কী সাহস! আমি তো বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কই আমারতো এখনো এত সাহস হয় নি। একা একা আমি ঘুমোতে পারি না। আমার সঙ্গে নাবিলের মাকে ঘুমাতে হয়, এশাকে ঘুমোতে হয়। তারপরও আমার ভয়ে শরীর কাঁপে।
নাবিল মনেমনে হাসল। সে জানে তার বাবার খুবই সাহস। তার বাবা ইচ্ছা করলেই একা ঘুমোতে পারেন। কিন্তু বড়রা ছোটদের সাথে এরকম মজা করে মিথ্যা কথা বলে। বড়রা মনে করে ছোটরা কিছু বুঝতে পারছে না। আসলে সবই বুঝতে পারে।
নাবিল বলল, ‘বাবা, একটা গল্প বলতো।’
বাবা মুখ শুকনো করে বললেন, ‘কী গল্প?’
নাবিল মনেমনে খুব হাসল। গল্প বলার কথা বলতেই বাবার মুখ শুকিয়ে গেছে। কারণ বাবা গল্প বলতে পারেন না। মা সব গল্প জানেন, বাবা কোনো গল্পই জানেন না। একবার সে বাবাকে সিনডারেলার গল্প বলতে বলল। বাবা গল্প শুরু করলেন—’এক দেশে ছিল এক সিনডারেলা। তার মনে বেজায় দুঃখ। কারণ তার কোনো ছেলেপুলে নেই। মনের দুঃখে তার সোনার অঙ্গ কালি হয়ে গেল।‘
নাবিল হাসতে হাসতে বাঁচে না। বাবাকে বিপদে ফেলার সবচে সহজ বুদ্ধি হচ্ছে। তাঁকে গল্প বলতে বলা। আজ নাবিলের খুব ইচ্ছা করছে বাবাকে বিপদে ফেলতে। সে আবারো বলল, ‘বাবা গল্প বলো।‘
বাবা আমতা আমতা করে বললেন, কিসের গল্প রে?
‘পরীর গল্প।’
‘ও আচ্ছা পরীর গল্প। হুঁ। পরী।‘
‘পরীর গল্প জান না বাবা?
‘জানব না কেন। অবশ্যই জানি। এক দেশে ছিল এক পরী। তারপর কী হল শোন। পরীর মনে বেজায় দুঃখ। কারণ তার কোনো ছেলেপুলে নাই। মনের দুঃখে তার সোনার অঙ্গ কালি হয়ে গেল।
নাবিল বলল, ‘বাবা চুপ করতো। থাক তোমার গল্প বলতে হবে না। তুমি আসলে পরীর কোনো গল্পই জান না। বলতো দেখি পরীরা কী খায়?’
‘কী আবার খাবে। ভাত-মাছ-ভেজিটেবল খায়। গাজর খায়। গাজরে আছে ভিটামিন এ। চোখের জন্য ভাল। পরীরা বেশি করে গাজর খায় বলে ওদের চোখ খুব ভাল থাকে। তারা আকাশ থেকে দেখতে পায়।‘
‘বাবা, তুমি কিছুই জান না। পরীরা ফুলের মধু খায়। আচ্ছা বলতো পরীদের জামা কাপড় কী দিয়ে তৈরি হয়?’
‘কী দিয়ে আবার, সূতা দিয়ে। ফিফটি পার্সেন্ট কটন আর ফিফটি পার্সেন্ট সিনথেটিক। শুধু সিনথেটিক কাপড় ওরা পরতে পারে না, গা কুটকুট করে।’
‘পরীদের ব্যাপারে বাবা তুমি কিছুই জান না। ওদের জামা-কাপড় তৈরি হয় চাঁদের আলোর সূতা দিয়ে।‘
‘ও আচ্ছা। চাঁদের আলো দিয়ে সূতা হয়। তাইতো জানতাম না।‘
‘চাঁদের চড়কা-বুড়ি কী করে? সূতা কাটে না?’
‘আরে তাইতো, চড়কা-বুড়ির ব্যাপারটাই ভুল মেরে বসে আছি।’
‘পরীরা পৃথিবীতে কখন আসে তা কি তুমি জান বাবা?’
‘জানি না। কখন আসে?’
‘যখন খুব জোছনা হয় তখন আসে। নির্জন পুকুরে ওরা সাঁতার কেটে গোছল করে।‘
‘পরীর দেশে পুকুর নেই?’
‘আছে বোধহয়। তবু পৃথিবীর পুকুর ওদের বেশি ভাল লাগে।‘
‘এত কিছু তুমি জানলে কী করে?’
নাবিল জবাব দিল না। মনেমনে হাসল। বড়দের ধারণা শুধু তারাই সবকিছু জানে। কিন্তু ছোটরাও যে অনেক কিছু জানে তা তারা ভুলেই যায়।