তুহিন বলল, অবশ্যই আছে।
কাকটা চিন্তিত গলায় বলল, তোমার কি জ্বর নাকি?
হুঁ।
দেখে তো মনে হচ্ছে অনেক জ্বর। আমরা তোমাকে খুব পছন্দ করি, সেটা কি তুমি জানো?
না।
তুমি আমাদের রোজ পাউরুটি খাওয়াও, এইজন্যেই পছন্দ করি। কাকদের তো আর কেউ আদর করে কিছু খাওয়ায় না। আমরা দেখতে অসুন্দর। আমাদের কেউ পাখি বলেই মনে করে না। শুধু তুমি করো। তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে আমাদের খারাপ লাগবে। তোমার জ্বর তো মনে হয় খুব বাড়ছে।
হুঁ।
আহারে! তোমার জন্যে কী করা যায় বলো তো?
তুহিন ক্লান্ত গলায় বলল, কিছু করতে হবে না।
তোমার বাবা-মা কেউ দেখি বাসায় নেই। তোমার খারাপ লাগছে না?
লাগছে।
টেলিফোন করে তাদের আসতে বলো।
ইচ্ছা করছে না।
তোমার অবস্থা দেখে তো চিন্তা লাগছে। কী করা যায় বলো তো।
তুহিন জবাব দিল না। তার জ্বর হু হু করে বাড়তে থাকল। সন্ধ্যাবেলা তুহিনের মা বাসায় ফিরলেন। ছেলের অবস্থা দেখে তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। তাকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। চারদিকে ছোটাছুটি পড়ে গেল।
তুহিনকে বরফ মেশানো ঠান্ডা পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে দেওয়া হলো। মা বললেন, বাবা, খুব খারাপ লাগছে?
তুহিন বলল, হুঁ।
তোমার শরীর এত খারাপ করেছে, তুমি বাবাকে একটা টেলিফোন করলেই তো বাবা চলে আসত।
বাবার ওপর আমি রাগ করেছি, এইজন্যে টেলিফোন করি নি।
রাগ করেছ কেন?
বাবা ভুল কথা বলেছে–এইজন্যে রাগ করেছি। কাকরা কোকিলের বাসায় ডিম পাড়ে না, তারা নিজেদের বাসাতেই ডিম পাড়ে।
কে বলেছে তোমাকে?
কাক বলেছে?
কাক বলেছে মানে? কাক কীভাবে বলবে?
কাকরা মানুষের মতো কথা বলতে পারে। তারা যখন খুব বিপদে পড়ে তখন মানুষের মতো কথা বলে। এখন তারা খুব বিপদে পড়েছে। গাছ কেটে ফেলা হবে-ওরা যাবে কোথায়? এইজন্যেই তারা মানুষের মতো আমার সঙ্গে কথা বলেছে।
মা বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার জ্বর এখন বেশি। তুমি চুপ করে থাকো। তোমার বাবা আসুক, তার সঙ্গে তখন কথা হবে।
তুহিনের বাবা রাত আটটার দিকে এলেন। ততক্ষণে তুহিনের জ্বর নেমে গেছে। তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। বাবা বললেন, তুহিন শোনো। কাঠগোলাপের গাছ কাটাটা আপাতত বন্ধ আছে। কাজেই গাছ কাটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে না। সবার ধারণা গাছের চিন্তায় তোমার জ্বর এসে গেছে। তুমি খুশি তো?
তুহিন বলল, হ্যাঁ।
তুমি নাকি তোমার মাকে বলেছ কাক তোমার সঙ্গে কথা বলেছে?
হ্যাঁ বলেছি।
বাবা শোনো, কাক মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারে না। তোমার জ্বর খুব বেশি হয়েছিল। মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল বলেই মনে হয়েছে কাক তোমার সঙ্গে কথা বলেছে। বুঝতে পেরেছ?
তুহিন জবাব দিল না।
বাবা বললেন, তবে তুমি যে বুদ্ধি করে বলেছ কাক তার নিজের বাসাতেই ডিম পাড়ে–এটা ঠিক। আমি পক্ষীবিশারদের কাছে খোঁজ নিয়েছি।
তিনি ছেলের পাশে বসে ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, পশুপাখি মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারে না–এটা খুব দুঃখের। কথা বলতে পারলে ওরা সরাসরি ওদের সমস্যার কথা বলতে পারত।
তুহিন বিড়বিড় করে বলল, বাবা, অন্য পশুপাখিদের কথা জানি না; তবে কাকে যখন খুব বিপদে পড়ে তখন কথা বলে।
বাবা হাসলেন। কিছু বললেন না। তিনি বুঝতে পারছেন অসুস্থ ছেলের মাথায় ‘কাক কথা বলে’ এই ব্যাপারটা ঢুকে গেছে, এটা সহজে যাবে না। কিন্তু একটা খটকা তাঁর নিজের মাথাতে তৈরি হয়েছে। তুহিনের ঘরের জানালার পাশে শত শত কাক। এবং আরও কাক আসছে। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এরা এসেছে তুহিনকে দেখতে।
কেমন করে সবাই তাকিয়ে আছে তুহিনের দিকে।
তাদের চোখে অশ্রু টলমল করছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি তারা কেঁদে ফেলবে। এই রহস্যের ব্যাখ্যা কী?
বাবা কাকদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুহিন ভালো আছে। তোমরা এখন যেতে পারো।
এই কথায় সব কাক একসঙ্গে নড়ে উঠল এবং একসঙ্গে উড়ে গিয়ে কাঠগোলাপ গাছে বসল। এর মানেই বা কী? এরা কি সত্যি কথা বুঝতে পারছে?
পরীর মেয়ে মেঘবতী
আজকের দিনটা অন্যসব দিনের মত না।
আজ খুব আলাদা একটা দিন। কেউ তা বুঝতে পারছে না বলে নাবিলের একটু মন খারাপ লাগছে। আচ্ছা, আজকের দিনটা যে আলাদা তা কেউ বুঝতে পারছে না কেন?
না না আজ তার জন্মদিন না। দু’মাস আগে নাবিলের জন্মদিন হয়ে গেছে। ছ’টা মোমবাতি জ্বালিয়ে সে গাল ফুলিয়ে ফুঁ দিয়েছে। এক ফুঁতে সব মোমবাতি নেভাতে হবে। সহজ ব্যাপার না। এক ফুঁতে সব বাতি নেভাতে পারলে একটা সাংঘাতিক ব্যাপার হয়। তখন চোখ বন্ধ করে যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়। নাবিলের ভাগ্য ভালো, সে এক ফুতে সব নেভাতে পেরেছে। এর আগে কখনো পারে নি, এই প্রথম পারল। গতবার সে সব বাতি নিভিয়ে ফেলেছিল। ও আল্লাহ, ফুঁ বন্ধ করতেই ফুট করে একটা বাতি জ্বলে গেল। তার আর কিছু চাওয়া হল না।
এইবার সে পেরেছে। সব বাতি নিভে যাবার পরেও সে অনেকক্ষণ ফুঁ দিয়েছে।
যেন গতবারের মতো না হয়। সবাই এমন হাততালি দিচ্ছিল যে তার লজ্জাই লাগছিল। মা বললেন, ‘নাবিল ব্যাটা, মেক এ উইশ।’ মেক এ উইশ মানে হচ্ছে কিছু একটা চাওয়া। সে চোখ বন্ধ করে একটা জিনিস চেয়েছে। জিনিসটা হচ্ছে সে যেন আলাদা একটা ঘর পায়। সেই ঘরে সে একা থাকবে, আর কেউ থাকবে না। ঘরে থাকবে ছোট্ট বিছানা, ওয়াল্ট ডিজনির ছবি, লিটল মারমেইড, লায়ন কিং, মুগলি।