কুঁড়োরাম একটা জবরদস্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আছিও বলা যায়, নেইও বলা যায়। তা হলে মরাই সাব্যস্ত করলে দু’জনে?”
জগাই বলল, “মরার মোটেই ইচ্ছে ছিল না মশাই! তবে কিনা মনে হচ্ছে মরণটাই হন্যে হয়ে খুঁজছে আমাদের।”
মাধাই মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, খুঁজে-খুঁজে হয়রান হচ্ছে বেচারা।”
কুঁড়োরাম বলল, “তা হলে বাপু, এগিয়ে পড়ো। পা চালিয়ে হাঁটলে কেল্লার আগেই নবীনকে ধরে ফেলতে পারবে। তারা বেশ দুলকি চালে হাঁটছে, দেখে যেন মনে হয়, হরিপুরে পৌঁছোনোর মোটেই গরজ নেই।”
জগাই বলল, “আচ্ছা মশাই, নবীনের সাঙাত ওই নিমাই লোকটা কে বলুন তো!”
“হাড়বজ্জাত লোক হে। তবে পাজি হতে হলে ওরকমই হতে হয়। যেমন বুদ্ধি, তেমনই চারচোখো নজর, যেমন সাহস তেমনই গায়ের জোর, তার মনের কথা আঁচ করার উপায় নেই কিনা। এই গ্যানার কথাই ধরা, খুনখারাপি, লুটমার করে বেড়ায়, লোকে ভয়ও খায়, কিন্তু মাথায় কি একরত্তি বুদ্ধি আছে? এই যে নিমাই রায় ওর সঙ্গে সাঁট করেছে, শিকার ধরে দিয়ে মজুরি বাবদ কমিশন নেবে, তাতেই গ্যানা কাত। বুদ্ধি থাকলে বুঝতে পারত নিমাই রায় ওকে ল্যাজে খেলাচ্ছে। এই ভুরফুনের মাঠেই একদিন গ্যানাকে পুঁতে ওর দলের দখল নেবে নিমাই। না হে বাপু, বড্ড বেশি কথা কয়ে ফেলছি। তোমরা বরং এগিয়ে পড়ো। সন্ধে সাতটা এগারো মিনিটে মাহেন্দ্রক্ষণ আছে, এই সময়টায় যদি শহিদ হতে পারো তবে সোজা বৈকুণ্ঠলোকে চলে যেতে পারবে।”
মাধাই বিরক্ত হয়ে বলে, “যাচ্ছি মশাই, যাচ্ছি। ওঃ, আমাদের যমের মুখে ঠেলে দিতে যে ভারী আহ্লাদ আপনার!”
খুক করে একটু হাসির শব্দ হল। তারপর কুঁড়োরাম বলল, “কী করব বলল, আজকাল যে আমার রক্তারক্তি কাণ্ড দেখতে বড্ড ভাল লাগে!”
৩. চারদিকে কুয়াশামাখা জ্যোৎস্না
চারদিকে কুয়াশামাখা জ্যোৎস্নার ভূতুড়ে আলো, বেশি দূর অবধি চোখ যায় না। মাঝে-মাঝে শেয়ালের দৌড়-পায়ের আওয়াজ, হুতুম প্যাচার গম্ভীর ডাক শোনা যায়। একটা-দুটো বাদুড় চাঁদের চারদিকে চক্কর মেরে উড়ে গেল। উত্তরে হিম বাতাস বইছে খুব। নবীন আর নিমাই কখনও পাশাপাশি, কখনও আগু-পিছু হয়ে হাঁটছে। নিমাইয়ের ডান কাঁধে লাঠিগাছ।
নিমাই হঠাৎ বলল, “কেল্লাটা আর কতদূর বলো তো?”
“আর মিনিট দশেক হাঁটলেই ভাঙা কেল্লা। হরিপুরের অর্ধেক পথ।”
“বাঃ বেশ! এসেই গেলুম প্রায়, কী বলো?”
“তা বটে, তবে আমরা তো আর কেল্লায় যাচ্ছি না, যাচ্ছি হরিপুর। তার এখনও ঢের দেরি। বললাম না, অর্ধেক পথ।”
“ওই হল। কেল্লা এসে গেলেই মার দিয়া কেল্লা। বাকি পথটুকু উড়ে বেরিয়ে যাবে, কী বলে? কথায় বলে না কেল্লা ফতে!’তা ওই কেল্লাটায় কী আছে বলো তো?”
নবীন হেসে বলল, “কী আর থাকবে! ইঁদুর, বাদুড়, চামচিকে, সাপখোপ আছে বলেই তো শুনি! ভূতপ্রেতও নাকি আছে।”
“ভিতরে গেছ কখনও?”
“না। গাঁয়ের গুরুজনরা কেল্লায় যেতে বারণ করত।”
“কেন বলো তো!”
“নানা লোকে নানা কথা বলে। কেল্লা নাকি ভাল জায়গা নয়।”
“দুর, দুর! কেল্লা তোফা জায়গা। আমার তো খুব ইচ্ছে, আর একটু বয়স হলে কেল্লার একধারে একটু সারিয়ে-টারিয়ে নিয়ে থাকব। চারদিকটা ভারী নিরিবিলি।”
“অনেকে কেল্লায় গুপ্তধন খুঁজতেও যায়।” বলে নবীন হাসল।
নিমাই গম্ভীর হয়ে বলল, “হাসির কথা নয়। পাঁচশো কি সাড়ে পাঁচশো বছরের পুরনো কেল্লা। গর্ভগৃহে সোনাদানা থাকা কিছু বিচিত্র নয়। আগের দিনে সোনাদানা সব পুঁতে রাখারই রেওয়াজ ছিল কিনা। আমিও ভাবছি কেল্লায় ডেরা বাঁধার পর রোজ গুপ্তধন খুঁজব। সোনাদানা না পাই, সময়টা তো বেশ কেটে যাবে! কী বলো!”
“আর পেলে?”
“ওঃ, তা হলে তো কথাই নেই। অনেকদিনের ইচ্ছে, একটা মন্দির বানাব, মন্দিরের চুড়োটা হবে সোনায় মোড়া।”
“কোন ঠাকুরের মন্দির?”
“সেইটেই এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি। আসলে আমাদের তো মেলা ঠাকুর!”
নিমাই হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বলল, “আচ্ছা, একটা মন্তর পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে না! এই রাতে উদোম মাঠের মধ্যে মন্তর পড়ছে কে বলো তো!”
নবীন অবাক হয়ে বলল, “কই, আমি তো শুনতে পাচ্ছি না!”
নিমাই চারদিকটা দেখে নিয়ে বলল, “কী কাণ্ড রে বাবা! তুমি শুনতে পাচ্ছ না, কিন্তু আমি যে বেশ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, গুনগুন করে কে যেন মন্তর আওড়াচ্ছে! গম্ভীর গলা, দূর থেকে আসছে মনে হয়।”
নবীন কান খাড়া করে খানিকক্ষণ শুনল। ঝিঁঝির ডাক আর বাতাসের শব্দ ছাড়া কিছুই কানে এল না তার। বলল, “ও আপনার মনের ভুল।”
“মনের ভুল! বলো কী? এই তো স্পষ্ট শুনছি। আস্তে শোনা যাচ্ছে। বটে, কিন্তু গমগমে গলা।”
“তা হলে আমি শুনতে পাচ্ছি না কেন নিমাইদা? আমার কান তো খুব সজাগ। বাগানে একটা শুকনো পাতা খসে পড়লেও শুনতে পাই।”
একথা শুনে নিমাই হঠাৎ গুম হয়ে গেল। আর দ্বিরুক্তি না করে গম্ভীর মুখে ফের হাঁটতে লাগল। এবার আর দুলকি চালে নয়, বেশ হনহন করে। তার সঙ্গে তাল রাখতে রীতিমতো বেগ পেতে হচ্ছিল নবীনের।
কিছুক্ষণ হাঁটার পর ফের নিমাই জিজ্ঞেস করে, “কেল্লাটা আর কতদূর?”
নবীন বলল, “এসে গেছি প্রায়। ওই বটগাছটা পেরোলেই কেল্লা দেখা যাবে।”
“মন্তরের জোরটা বাড়ছে, বুঝলে? কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে।”
“কীসের মন্তর তা বুঝতে পারছেন?”