মাধাই চোখ বড় বড় করে বলল, “গুপ্তধন কি তা হলে নেই?”
“ওসব আমি জানি না বাপু। তোদের কণ্ঠদাদা যখন বলেছে তখন আমি তোদের বাড়া ভাতে ছাই দিতে যাব কেন? আজকাল কারও উপকারও যেমন করি না, তেমনই আবার অপকারও করি না কিনা! বুকের জোর আর তাকত থাকলে গিয়ে দ্যাখ না। গুপ্তধনের আগে গ্যানা আছে, তার দলও ঘাপটি মেরে আছে। এসময়ে উটকো লোক হাজির হলেনা বাপু, বড্ড বেশি কথা কয়ে ফেলছি। ওইটেই তো আমার দোষ!”
জগাই কঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “কথা কইছেন বটে, তবে সবই তো সাঁটে। পরিষ্কার করে বুঝতে পারছি কই? মাধাইদা, তুমি কিছু বুঝলে?”
মাধাই গম্ভীর হয়ে বলল, “দুটো পয়সার মুখ আর বোধহয় এ জন্মে দেখা হল না রে জগাই।”
কুঁড়োরাম একটু নরম গলায় বলল, “আহা, অত ভেঙে পড়ছিস কেন? তোদের আর ক্ষতিটা কী হল? নবীন সাহার বিপদটা একটু ভেবে দ্যাখ। সে তো ধনে-প্রাণেই মরবে আজ। তোদের তো তবু প্রাণটা আছে।”
মাধাই আর জগাই খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল। তারপর হঠাৎ কুঁড়োরামের কথাটা যেন সেঁধোল মাথায়, মাধাই আচমকা লাফিয়ে উঠে বলল, “তাই তো! নবীনটা যে বড্ড ভাল ছেলে রে জগাই! কতবার আমাদের দোকানে বেগুনি আর মোচার চপ খেয়ে তারিফ করে গেছে!”
জগাইও ঝুঁকি মেরে উঠে পড়ল, “হ্যাঁ তো মাধাইদা! নবীনের যে এত বড় বিপদ সেটা তো খেয়াল হয়নি। তাকে যে হুঁশিয়ার করা দরকার।”
অদৃশ্য কুঁড়োরাম নির্বিকার গলায় বলল, “পরোপকারের বাই চাগাড় দিয়েছে বুঝি! তা ভাল, আমারও চাগাড় দিত কিনা, লক্ষণ খুব চিনি। সেবার গুণময় মণ্ডলের বকনা বাছুর হারিয়ে গেল বলে আমি গোটা পরগনা চষে ফেলেছিলাম। দিনতিনেক বাদে যখন খিদে-তেষ্টায় চিচি করতে করতে বাছুর নিয়ে ফিরলাম, তখন গুণময় কী বলল জানিস? চোখ রাঙিয়ে, সপ্তমে গলা তুলে, পাড়া জানান দিয়ে চেঁচাতে লাগল, তুই হারামজাদাই আমার বাছুর চুরি করেছিলি! থানায় এত্তেলা দেওয়াতে ভয় খেয়ে ফেরত দিতে এসেছিস; চল, তোকে ফাটকে দেব। পাঁচজন জড়ো হয়ে গিয়েছিল, তারাও বলাবলি করছিল, চুরি করেছিলি তো করেছিলি, বাছুরটা সীতাপুরের গো-হাটায় বেচে দিলেই পারতিস। আহাম্মকের মতো কেউ চুরির জিনিস ফেরত দিতে আসে?’ সেবার যে কী নাকাল হতে হয়েছিল তা আর বলার নয়।”
জগাই আমতা-আমতা করে বলল, “এ কথাটাও কি সাঁটে বলা হল কুঁড়োদা?”
মাধাই চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে বলল, “তার মানে আমরা নবীনকে বাঁচাতে গিয়ে ফ্যাসাদে পড়ব। এঁরা সব ঠিক মানুষ রে জগাই, বহু দূর দেখে তবে কথা কন।”
জগাইয়ের মনটা খারাপ, দুর্বল গলায় বলল, “তা বলে ছেলেটা বেঘোরে প্রাণটা দেবে নাকি মাধাইদা? আমাদের প্রাণের আর কী দাম বলো! ডাকাত-বদমাশের হাতে না মরলেও না-খেয়ে মরা তো কপালে লেখাই আছে। জীবনে কখনও একটা সাহসের কাজ করলুম না। আজ চোখ বুজে একটা করেই ফেলব নাকি মাধাইদা?”
মাধাই অনিচ্ছুক গলায় বলল, “কখনও ডাব-চিংড়ি খেয়েছিস রে জগাই?”
“না তো! কীরকম জিনিস সেটা?”
“আমিও খাইনি। ডাবের মধ্যে চিংড়ি মাছ দিয়ে করে। খেতে নাকি অমৃত, বড় সাধ ছিল মরার আগে একবার ডাব-চিংড়ি খেয়ে মরি। তারপর ধর, সেবার শিবরাত্রির মেলায় কী একটা সিনেমা যেন দেখলুম, তাতে দেখি, ভোরবেলা কাশীর ঘাটে লোকেরা ডনবৈঠক দিচ্ছে। দেখে বড় ইচ্ছে ছিল কাশীতে গিয়ে আমিও একবার ভোরবেলা ওরকম ডনবৈঠক দেব। তারপর ধর, হেঁটো ধুতি পরেই তো জীবনটা কাটল, জীবনে একবার একখানা আশি সুতোর কাপড় পরার বড় ইচ্ছে ছিল রে! দিব্যি কুঁচিয়ে কেঁচা দোলাব, আগাটা আবার ময়ূরের পেখমের মতো একটু ছড়িয়ে পিরানের পকেট থেকে উঁকি মারবে। তা সেসব আর হয়ে উঠল না। সে যাক গে। চল, আজ মরেই দেখি বরং।”
জগাই বিরক্ত হয়ে বলল, “দ্যাখো দিকি কাণ্ড! ওসব কথা কয়ে তুমি যে আমাকে কাহিল করে দিলে। আমারও যে বুকের মধ্যে উথাল-পাথাল হতে লেগেছে!”
“কেন রে, তোর আবার কী হল?”
“তোমার মতো বড় বড় আশা নেই আমার, কিন্তু ছোটখাটো কয়েকটা সাধ যে আমারও ছিল। ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিলুম, কিন্তু এখন সেগুলো চাগাড় মারতে লেগেছে যে! কেষ্টনগরের সরভাজা খেয়েছ কখনও? লোকে বলে সে নাকি একবার খেলে মরণ অবধি তার স্বাদ জিভে জড়িয়ে থাকে। তারপর ধরো, ওই যে মাউথ অর্গান কী যেন বলে, ঠোঁটে সাঁটিয়ে প্যাপোর-প্যাপোর বাজায়, খুব ইচ্ছে ছিল পয়সা হলে ওর একটা কিনে মনের সুখে হিন্দি গান বাজাব। আর একটা সাধও ছিল, কিন্তু বলতে লজ্জা করছে!”
“আর লজ্জা কীসের রে? একটু বাদেই যাদের মরতে হবে তাদের কি লজ্জা-ঘেন্না-ভয় থাকতে আছে?”
“তা হলে বলেই ফেলি! সেই যে বাজপুরের সত্যেনবাবু কী একটা সুগন্ধী মেখে মাঝে-মাঝে গঞ্জে আসে, শুকেছ কখনও? আহা, গন্ধটা নাকে এলে যেন প্রাণটা জুড়িয়ে যায়, বুক ঠান্ডা হয়, মনটা গ্যাস বেলুনের মতো উপর দিকে উঠে যায়। ইচ্ছে ছিল ওরকম এক শিশি সুগন্ধী কিনে কয়েকদিন কষে মেখে নেব। তা সেসব ভাবতে গেলে তো আর মরাই হবে না আমাদের।”
“যা বলেছিস। বেঁচে থাকলেও ওসব কি আর জুটত রে? তার চেয়ে চল, মরে ফিরে-যাত্রা করে আসি। বীরের মতো মরলে নাকি পরের জন্মটা দুধে-ভাতে কাটানো যায়।”
এতক্ষণ কুঁড়োরাম রা কাড়েনি। জগাই সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করল, “কুঁড়োদাদা কি এখনও আছেন?”