জগাই মাথা চুলকে বলল, “শুনেছি নাকি মাধাইদা?”
মাধাই ঘাড় চুলকে, মাথা নেড়ে, অনেকক্ষণ ভেবে বলল, “শুনেই থাকব। তবে আমাদের তো মোটা মাথা, তাই কিছু মনে থাকে না। সেইজন্যই তো লেখাপড়া হল না কিনা! আট বছরের চেষ্টায় সাত ঘরের নামতা মুখস্থ হয়।”
জগাই বলল, “আমার তো আকবরের ছেলের নাম আজও মনে নেই। কত বেত খেয়েছি তার জন্য।”
গলার স্বর বলল, “তা আজকাল আর ততটা শোনা যায় না বটে, চ্যাংড়া-প্যাংড়াদের মনে থাকার কথা নয়, কিন্তু গঞ্জের বুড়ো মানুষদের কাছে নামটা বলে দেখো, জোড় হাত কপালে ঠেকাবে। পরোপকারী হিসেবে একসময়ে খুব নাম ছিল হে আমার। সারাদিন কেবল পরোপকার করে বেড়াতুম। এমন নেশা যে, নাওয়া-খাওয়ার সময় জুটত না। এই কারও কাঠ কেটে দিলুম, কাউকে জল তুলে দিয়ে এলুম, কারও বেড়া বেঁধে দিলুম, কারও মড়া পুড়িয়ে এলুম, কারও গাছ থেকে নারকোল পেড়ে দিলুম, কাউকে পাঁচটাকা ধার বা কাউকে দু’ চার পয়সা ভিক্ষে দিলুম, কারও বাড়িতে ডাকাত পড়লে হাউড় দিয়ে গিয়ে পড়লুম। ওঃ, সে কী পরোপকারের নেশা! তাতে অবশ্য মাঝে মাঝে বিপদেও পড়তে হয়েছে। যেদিন পরোপকারের কিছু খুঁজে পেতাম না সেদিন ভারী পাগল-পাগল লাগত। একদিন তো গণেশ পুতিতুণ্ডর পিঠ চুলকোতে বসে গেলুম। গণেশ তখন খুব মন দিয়ে সেলাই মেশিনের সুচে সুতো পরাচ্ছিল। বাধা পড়ায় এই মারে কি সেই মারে। আর একদিন কাজ না পেয়ে নদীয়া দাসের দাওয়ায় একটা বুড়ো মানুষ শুয়ে আছে দেখে ভাবলুম বুড়ো বয়সে তো লোকের পায়ে ব্যথাট্যথা হয়, তা দিই লোকটার পা টিপে বসেও গেলাম পা টিপতে। লোটা প্রথমটায় উচ্চবাচ্য করল না, একটু বাদে বেজার মুখে বলল, ঝুটমুট মেহনত করছেন বাবু, ওটা আমার কাঠের পা।”
মাধাই হাতজোড় করে কাতর গলায় বলল, “গুরুতর বিষয়কর্ম রয়েছে মশাই, এবার আমাদের বিদেয় হতে আজ্ঞা করুন।”
কুঁড়োরাম ভারী উদাস গলায় বলল, “যাবে? তা যাও! পরের উপকার করা আমি বহুকাল ছেড়ে দিয়েছি। এখন মানুষের বিপদ দেখলেও চুপটি করে থাকি। যা হচ্ছে হোক, আমার কী?”
জোর একখানা গলাখাঁকারি দিয়ে গলার ফাঁসফেঁসে ভাবটা ঝেড়ে ফেলল জগাই। তারপর ভারী শ্রদ্ধার সঙ্গে বলল, “তা ইয়ে, কুঁড়োরামদাদা, আমাদের কি কোনও বিপদ দেখতে পাচ্ছেন? কথাটা এমনভাবে কইলেন যে বুকের ভিতরটা কেমন খামচা মেরে উঠল।”
মাধাইও তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমারও যেন কেমন একটা হল। ঠিক খামচা নয়, গরম তেলে বেগুন পড়লে যেমন ছাত করে ওঠে, অনেকটা সেরকম।”
জগাই ফের বলল, “কুঁড়োরামদাদা, আপনার ভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন গতিক সুবিধের নয়!”
মাধাইও পোঁ ধরে বলল, “মনটা যে বড্ড কু গাইছে কুঁড়োদা।”
কুঁড়োরাম বলে উঠল, “ওরে না, না, পরের উপকার করা আমি ভুলেই গেছি। এই তো সেদিন মহেশপুরে ‘মহিষাসুর বধ’ পালায় যে ছোঁকরা চোমরানো গোঁফ লাগিয়ে কার্তিক সেজেছিল, সে একটা সিনের শেষে ছারপোকা কামড়ানোয় গোঁফটা খুলে নাকের নীচে চুলকোতে গিয়ে পরের সিনে গোঁফ লাগাতে ভুলে গিয়েছিল। চোখের সামনে দেখেও কিচ্ছুটি বলিনি। যা হয় হোক, আর হলও তাই। গোঁফ ছাড়া পরের সিনে নামতেই হইহই কাণ্ড। পালা নষ্ট হওয়ার জোগাড়।”
“আমাদের উপর অত বিমুখ হবেন না কুঁড়োদা।”
জগাইও বলে উঠল, “আমাদের গায়ের জোর, মনের জোর, ট্যাঁকের জোর, বরাতের জোর, মুরুব্বির জোর, বুদ্ধির জোর, কোনও জোরই নেই কিনা।”
কুঁড়োরাম ফস করে একটা শ্বাস ফেলার মতো শব্দ ছাড়ল। তারপর বলল, “এই তো সেদিন বর্ষাকালের সন্ধেবেলায় গয়ারামবাবু চণ্ডীমণ্ডপে বসে গাঁয়ের মাতব্বরদের সঙ্গে কূটকচালি করতে করতে আনমনে তামাকের নল ভেবে সাপের লেজ টেনে নিয়ে মুখে দিয়েছিলেন, চোখের সামনে দেখেও কিছু বলেছি কি? কিচ্ছু বলিনি। যা হয় হোক।”
জগাই শশব্যস্তে বলল, “তা কী হল?”
“বরাতের জোর ছিল খুব। সাপটা ছোবলও মেরেছিল বটে, তবে সেটা গিয়ে পড়ল গয়ারামবাবুর খড়মে। তাইতেই সাপটার দুটো বিষদাত ভেঙে রক্তারক্তি কাণ্ড।”
ফের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কুঁড়োরাম। সেই শুনে কাঁদো কাঁদো হয়ে মাধাই বলল, “তবে কি আপনি ভাঙা কেল্লায় যেতে মানা করছেন কুঁড়োদা? কিন্তু মেলা সোনাদানা যে তা হলে হাতছাড়া হয়?”
“আমি কেন মানা করব রে? যাবি তো যানা। এই তো একটু আগে, পড়ন্ত বিকেলে গ্যানা গুন্ডার দল লাঠি-সড়কি বন্দুক নিয়ে ভাঙা কেল্লায় গেল। সেখানে তারা জটেশ্বর সাহার ছেলে নবীনের জন্য এখন ওত পেতে বসে আছে। নবীন গঞ্জে আদায় উসুল সেরে তাঁকে ত্রিশটি হাজার টাকা নিয়ে হরিপুরের দিকে এই একটু আগে রওনা হল। সঙ্গে আবার হাড়ে বজ্জাত নিমাইটাকেও জুটিয়েছে দেখলুম। একটু বাদেই সেখানে রক্তারক্তি কাণ্ড হবে। কিন্তু দ্যাখ, তবু কেমন চুপটি করে আছি। না বাপু, আমি আর পরোপকারের মধ্যে নেই। তোরা যেখানে যাচ্ছিস যা বাপু, যা খুশি কর, আমার তাতে কী?”
মাধাই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল, “গ্যানার দল! ওরে বাবা, তারা যে সাক্ষাৎ যমদূত!”
জগাইয়েরও মুখ শুকোল, “তা হলে কী হবে কুঁড়োদা? আমাদের বড়লোক হওয়া কি কপালে নেই?”
কুঁড়োরাম ভারী উদার গলায় বলল, “তাই কি বললুম রে? বড়লোক হওয়ার আশা যখন হয়েছে তখন গিয়ে কেল্লায় খোঁড়াখুঁড়ি লাগিয়ে দে। সাত ধাপ নীচে নেমে, ঘাম ঝরিয়ে হেদিয়ে গিয়ে যদি লবডঙ্কা পাস, তা হলেও আমি কিছু বলব না।”