জগাই ঝাঁকি মেরে বলল, “না, ভয়টা কীসের?” মাধাইও গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, “নাঃ, এখন যেন ততটা ভয় লাগছে না।”
“এই তো বাপের ব্যাটার মতো কথা! তা হলে শাবল আর কোদালের জোগাড় দ্যাখ, তারপর গড়িমসি ছেড়ে কাজে নেমে পড়। আগেই বলে রাখি, গুপ্তধন ছেলের হাতের মোয়া নয়। মেহনত করতে হবে। তারপর সোনাদানা দেখে ভিরমি খেয়ে পড়ে যদি অক্কা পাস তা হলে ভোগ করবে কে? কলজে শক্ত করে নে। কথায় বলে বীরভোগ্যা বসুন্ধরা।”
জগাই একগাল হেসে বলল, “না কণ্ঠদাদা, গায়ে বেশ জোর পাচ্ছি।”
মাধাই লাজুক লাজুক ভাব করে বলল, “তা কত হবে কণ্ঠদাদা? দশ-বিশ হাজার হবে না?”
কণ্ঠস্বর অট্টহাস্য করে বলল, “দুর মুখ! দশ-বিশ হাজার তো পাখির আহার। নজরটা একটু উঁচু কর দেখি মেধোতোর মতো ছোটলোককে গুপ্তধনের সন্ধান দিতে যাওয়াই বৃথা। বড্ড ভুল হয়েছে দেখছি।”
জগাই তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে বলল, “মাধাইদার কথা ধরবেন না কণ্ঠদাদা। পানুবাবুর একজন পাইক একবার মাথায় গাট্টা মেরেছিল, তারপর থেকেই মাধাইদার মাথাটার গণ্ডগোল। নইলে তোক বড্ড ভাল।”
মাধাইও কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “আজ্ঞে, গরিব মনিষ্যি তো, সোনাদানা আর চোখে দেখলুম কই? তবে রয়ে-সয়ে হয়ে যাবে। এখন থেকে না হয় লাখ-বেলাখের নীচে ভাববই না।”
“তা হলে খুব হুশিয়ার হয়ে শোন। ভাঙা কেল্লার পিছনে উত্তর-পুব কোণে এখনও পড়ো-পড়ো হয়ে কয়েকখানা ঘর খাড়া আছে। একেবারে কোনার ঘরখানায় গিয়ে মেঝের আবর্জনা সরিয়ে উত্তর-পূর্ব কোণের মেঝেতে শাবল ঠুকলেই বুঝবি ফাঁপা ঢ্যাবট্যাব আওয়াজ আসছে। কোদাল আর শাবল দিয়ে চাড় মারলে বড়সড় পাথরের চাঁই উঠে আসবে। সঙ্গে টর্চ আর মোমবাতি নিয়ে যাস বাপু। গর্তের মধ্যে নেমে পড়লেই দেখবি, দিব্যি একখানা কুঠুরি। তার জানলা-দরজা নেই কিন্তু। একেবারে যমপুরীর অন্ধকার। নেমে সোজা পুব-দক্ষিণ কোণে গিয়ে ফের শাবল ঠুকবি। চাড় মেরে ফের একখানা চাঁই তুলে ফেলবি। ওর নীচে ফের একখানা ঘর। নেমে সোজা দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে গিয়ে ফের ওরকমভাবেই আর একটা পাথরের চাঁই তুলে ফেলবি। নীচে আর-একখানা ঘর।”
মাধাই বলে, “ওরে বাপ! অত নীচে?”
“তবে কি তোকে কেউ থালায় করে গুপ্তধন বেড়ে দেবে?”
“ঘাট হয়েছে আজ্ঞে। আর ফুট কাটব না। বলুন।”
“নীচের ঘরে নেমে পড়লি তো! এবার উত্তর-পশ্চিম কোণের পাথরটা সরালি। ক’টা হল গুনছিস?”
জগাই বলল, “আজ্ঞে, এটা পাঁচ নম্বর ঘর।”
“মেরেই দিয়েছিস প্রায়। পাঁচ নম্বরে নেমে এবার ফের উত্তর-পূর্ব কোণের পাথর সরিয়ে ছয় নম্বর ঘরে নামবি। এইখানে নেমে ভাল করে ইষ্টনাম স্মরণ করে নিস। বুকটা যেন বেশি ধড়ফড় না করে। কয়েক ঢোক জলও খেয়ে নিতে পারিস। এবার পুব-দক্ষিণের পাথর সরিয়ে যেই নেমে পড়লি অমনি কিন্তু একেবারে হকচকিয়ে যেতে হবে।”
মাধাই শশব্যস্ত বলে উঠল, “কী দেখব সেখানে কণ্ঠদাদা!”
“ওঃ, সে বলার নয় রে, বলার নয়, উফ, সে যা দৃশ্য!”
জগাই হেঁ-হেঁ করে হেসে বলল, “তা কণ্ঠদাদা, আপনার হিস্যা কত?”
“ওসব কথা পরে হবে’খন। এখন কাজে লেগে যা। দেরি করিসনি বাপু, বাতাসেরও কান আছে। যা, যা, বেরিয়ে পড়।”
জগাই-মাধাই উঠে পড়ল।
কোদাল, শাবল, মোমবাতি, টর্চ, জলের ঘটি নিয়ে যখন দু’জনে বেরিয়ে খাল পেরোচ্ছে তখন সন্ধে গড়িয়ে রাত নেমেছে। ভুরফুনের মাঠে ভূতুড়ে কুয়াশা, আবছা জ্যোৎস্না আর হুহু বাতাসে দু’জনেরই একটু ভয়-ভয় করছে।
“কাজটা কি ঠিক হল রে জগাই! হুট বলতেই এই যে একটা বিপদের কাজে রওনা হলুম, শেষে ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু হবে না তো?”
“অত ভেবো না তো মাধাইদা। কণ্ঠদাদার দয়ার শরীর, নইলে কি এত বড় গুহ্য কথাটা আমাদের বলত? আমাদের যা অবস্থা তাতে শিয়াল কুকুরেরও চোখে জল আসে। সেই দুঃখেই না কণ্ঠদাদার মনটা নরম হয়েছে।”
“এই কণ্ঠদাদা লোকটা কে বল তো জগাই?”
জগাই মাথা চুলকে বললে, “লোক না পরলোক তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। ওসব নিয়ে ভেবে কী হবে বলো। কণ্ঠদাদা তো আমাদের উপকারই করেছে!”
ঠিক মাথার উপর থেকে কে যেন খ্যানখেনে গলায় বলে উঠল, “কে কার উপকার করল শুনি?”
দু’জনে চমকে দাঁড়িয়ে পড়ে ঠাহর করে দেখল একটা ঝুপসি গাছের নীচে তারা থেমেছে। শেওড়া গাছ বলেই মনে হচ্ছে। জগাই আর মাধাই পরস্পরের দিকে একটু সরে এল। জগাই ফ্যাসফেসে গলায় বলল, “কণ্ঠদাদা নাকি? গলাটা যে অন্যরকম লাগছে!”
গলার স্বরটা সড়াৎ করে গাছের নীচে নেমে একেবারে তাদের মুখোমুখি হল। বলল, “কণ্ঠদাদা? সেটি আবার কে হে?”
স্বর শোনা যাচ্ছে, কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না দেখে এবার তারা ততটা ঘাবড়াল না। আগের অভিজ্ঞতা তো আছে। মাধাই বলল, “আজ্ঞে আমরা কি আর তাকে তেমন চিনি! শুধু কণ্ঠস্বর শোনা গেছে, দেখা যায়নি। এই আপনার মতোই।”
“বুঝেছি। নিজের নাম কণ্ঠস্বর বলেছে তো!”
“যে আজ্ঞে।”
“মহা নচ্ছার জিনিসের পাল্লায় পড়েছ হে। বলি গুপ্তধনের সন্ধান দিয়েছে নাকি?”
জগাইয়ের গলাটা বড্ড বসে গেছে। ক্ষীণ গলায় বলল, “ওই আর কী!”
“কেল্লার কোণের ঘরে পাথর সরিয়ে সরিয়ে সাত ধাপ নামতে হবে, তাই না?”
মাধাই হতাশ হয়ে বলল, “বলতে নিষেধ ছিল। কিন্তু আপনি দেখছি সবই জানেন। আপনি কে বলুন তো!”
“কুঁড়োরাম রায়ের নাম নিশ্চয়ই শুনেছ! লোকের মুখে মুখে ফেরে, শোনোনি?”