“কিন্তু আমার যে বেজায় ভয় করছে। ওরে জগাই, তোরও করছে তো!”
“দাঁড়াও, ভেবে দেখি। হ্যাঁ গো মাধাইদা, আমার গা-টা বেশ শিরশির করছে, হাত-পায়ে যেন একটা খিল-ধরা ভাব, গলাটাও কেমন শুকনো-শুকনো। এ তো ভয়েরই লক্ষণ মনে হচ্ছে।”
গলাটা বেজায় খাপ্পা হয়ে বলল, “ওসব মোটেই ভয়ের লক্ষণ নয়। আজ দুপুরে ভাত খাওনি বলেই ওসব হচ্ছে।”
জগাই কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “দুশ্চিন্তায় খাওয়াদাওয়া যে মাথায় উঠেছে মশাই, খাওয়ার কথা মনেই পড়েনি।”
“ওসব খবর আমার জানা, তাই তো বলছি, ওসব মোটেও ভয়ের লক্ষণ নয়। তবে ভয় পাওয়ার সুবিধেও আছে। ভয় থেকে নানা ফিকির মাথায় আসে।”
জগাই একগাল হেসে বলল, “আপনি বেশ বলেন তো! তা আপনি কে বলুন তো! ভূতপ্রেত নাকি?”
“ওসব পুরনো বস্তাপচা কথা যে কেন তোমাদের মাথায় আসে তা কে জানে বাবা। ভূতপ্রেত মনে করার দরকারটাই বা কী? একজন বন্ধুলোক বলে ভাবলেই তো হয়!”
“তা নামটা?”
“কণ্ঠস্বর হলে কেমন হয়? ভাল না?”
জগাই গদগদ হয়ে বলে, “চমৎকার নাম।”
মাধাই তাড়াতাড়ি বলল, “তা কণ্ঠস্বরের কণ্ঠ লাগে। আপনার কণ্ঠটাও তত দেখা যাচ্ছে না মশাই।”
কণ্ঠস্বর এবার খ্যাক করে একটু হেসে বলল, “বলিহারি বাপু তোকে, বলি কণ্ঠ কি একটা দেখবার মতো জিনিস! জন্মে শুনিনি বাপু কেউ কারও গলা দেখতে চায়।”
মাধাই কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “তা মুখের ছিরিখানা যখন দেখাচ্ছেন না
তখন কণ্ঠটা দেখলেও একটু ভরসা পাওয়া যেত আর কী! ভয়ডরের একটা ব্যাপার তো আছে!”
“দ্যাখ মেধো, তোকে বহুকাল ধরে দেখে আসছি, লোক তুই মন্দ নোস বটে, কিন্তু জগাইয়ের মাথায় যে একরত্তি বুদ্ধি আছে তোর সেটুকুও নেই। বলি, গোটা মানুষটা ছেড়ে যদি শুধু তার গলাটা দেখতে পাস, তা হলেই কি তোর ভয় কমবে?”
মাধাই কুঁকড়ে গিয়ে বলল, “আজ্ঞে, সেটাও ভাববার কথা।”
“তবে! তার চেয়ে এই যে আমি মোটামুটি গায়েব হয়ে আছি। সেটাই কি ভাল নয়!”
“এখন তাই মনে হচ্ছে বটে।”
জগাই তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে বলল, “আমাদের দোষত্রুটি নেবেন না কণ্ঠদাদা, অবস্থা গতিকে আমরা বড্ড ঘেবড়ে আছি৷ মাথায় কোনও মতলব আসছে না।”
কণ্ঠস্বর বলল, “সে আমি খুব বুঝতে পারছি। ভেবেছিলুম কাউকে কোনওদিন বলব না। এসব গুহ্য কথা বলার আমার দরকারটাই বা কী? ধনরত্নে তো আর আমার কাজ নেই। কিন্তু তোদের অবস্থা দেখে আজ বড্ড বলি বলি ভাব হচ্ছে। ভাবলাম আহা এসব জিনিস এ-দুটো দুঃখী লোকের ভোগে লাগুক। দুনিয়ার ভালমন্দ জিনিস তো এরা চোখেও দেখেনি, চেখেও দেখেনি। সেই জন্যেই বলছি, মন দিয়ে শোন। শুনছিস তো?”
জগাই বলল, “কান খাড়া করে শুনছি কণ্ঠদাদা, আর শুনতে লাগছেও বেজায় ভাল। সত্যি কথা বলতে কী, সেই গেলবার রাসের দিনে রামশঙ্কর ভটচাজমশাইয়ের কীর্তনের পর আর কিছু এত ভাল লাগেনি। কী বলো মাধাইদা?”
মাধাই বেজার মুখে বলল, “তা কেন, শ্যামগঞ্জে সেবার যে নিমাই সন্ন্যাস’ পালা শুনলাম, তাই বা মন্দ কী?”
“তা বটে, সেইসঙ্গে মুকুন্দ রক্ষিতের কথকতার কথাও বলতে হয়, আহা, আজও চোখে জল আসে।”
একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। কণ্ঠস্বর ভারী মনমরা গলায় বলল, “নাঃ, তোদের দিয়ে হবে না রে, বলে লাভ নেই। টাকাপয়সার কথা শুনে কোথায় হামলে পড়বি, তা না, রাজ্যের বাজে কথা এনে ফেললি!”
জগাই কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, “দোহাই কণ্ঠদাদা, আর দগ্ধে মারবেন না। গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নিলে যে মারা পড়ব।”
মাধাইও গোঁ ধরে বলল, “তোরই তো দোষ। একটা গুরুতর কথা হচ্ছে, ধাঁ করে কেত্তন এনে ফেললি। ওতেই তো আমাদের সব কাজ ভন্ডুল হয়ে যায়।”
চোখ মিটমিট করে জগাই বলল, “ও কণ্ঠদাদা, আছেন কি?”
“আছি রে আছি। আজ তোদের ভাগ্যের চাকা ঘোরাব বলেই এখনও আছি। কিন্তু চাকা কি সহজে ঘুরবে? তোদের বুদ্ধির দোষে মরচে পড়ে আঁট হয়ে আছে। এখন মন দিয়ে শোন। ভুরফুনের মাঠ তো চিনিস?”
একগাল হেসে জগাই বলল, “তা চিনি না! এই তো খাল পেরোলেই সেই তেপান্তর।”
“ভুরফুনের মাঠের ভাঙা কেল্লা দেখেছিস তো!”
“আজ্ঞে, তবে দুর থেকে। কেল্লার কাছেপিঠে নাকি যেতে নেই। অজগর যেমন শ্বাস দিয়ে মানুষ, গোরু, মোষ সব টেনে নেয়, তেমনই নাকি ভাঙা কেল্লার ভিতরেও মানুষজনকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে হাপিশ করে ফেলে। সে নাকি ভূতপ্রেতের আখড়া।”
“তোর মাথা, মুখ কোথাকার। যারা কেল্লার ভিতর সোনাদানা খুঁজতে যায়, তারাই ওসব গল্প রটায়। যাতে আর কোনও ভাগীদার না জোটে। তবে খোঁজাই সার, কেউ কিছু পায়নি আজ অবধি।”
মাধাই তাড়াতাড়ি বলল, “তা হলে কেল্লার কথা উঠছে কেন আজ্ঞে! ও যে বড্ড ভয়ের জায়গা!”
কণ্ঠস্বর ফের খিঁচিয়ে উঠে বলল, “আর ধ্যাষ্টামো করিসনি তো মেধো। বলি এতই যদি তোর ভয়, তবে আমার সঙ্গে এতক্ষণ ধরে দাঁত কেলিয়ে কথা কইছিস কী করে! ভিরমি তো খাসনি!”
মাধাই মিইয়ে গিয়ে মিনমিন করে বলল, “ভয় যে লাগছে না তা তো নয়। একটু-একটু লাগছে।”
“ভয়টা কেমন জানিস! শীতকালে পুকুরে ডুব দেওয়ার মতো। প্রথম ডুবটাই যা শক্ত। তার পরের ডুবগুলোয় আর ঠান্ডা লাগে না। একবার ভয়টা কেটে গেলেই হয়ে গেল। তা ছাড়া দাঁওটাও তো কম নয় রে বাপু। ওখানে যা পাবি তাতে তোরা, তোদের পুত্র পৌত্রাদি, তস্য পুত্র পৌত্রাদি, তস্য পুত্র পৌত্রাদি সাত পুরুষ পায়ের উপর পা তুলে গ্যাঁট হয়ে বসে চৰ্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় খেয়ে গেলেও ফুরোবে না। বুঝলি! এখন ভেবে দ্যাখ, ভয় পাওয়াটা উচিত কাজ হবে কি না।”