শীতের সন্ধে। চারদিকে একটা ভূতুড়ে কুয়াশা পাকিয়ে উঠছে। আবছায়ায় যতদূর চোখ যায়, মাঠঘাট শুনশান। জনমনিষ্যি নেই। চারদিকটা থমথম করছে।
খানিকক্ষণ চুপচাপ হাঁটার পর নিমাই হঠাৎ চাপা গলায় বলে উঠল, “একটা কথা বলে রাখছি তোকে।”
নবীন তটস্থ হয়ে বলে, “কী কথা নিমাইদা?”
“এই শীতকালে ফুলকপির পোরের ভাজা তোর কেমন লাগে?”
“খুব ভাল।”
“আমারও।”
“সে হয়ে যাবে, ভাববেন না।”
“আর কড়াইশুটি দিয়ে সোনা মুগের ডাল?”
“তাও হবে।”
“ভাল ঘি আছে বাড়িতে?”
“খাঁটি সরবাটা ঘি।
“গরম ভাতে এক খাবলা ঘি হলে কাঁচালঙ্কা দিয়ে মন্দ লাগে না। কী বলিস? মাছ-মাংসের উপর আমার তেমন টান নেই, তবে রুই মাছের কালিয়াটা খারাপ নয়।”
“ধরে নিন হয়েই গেছে।”
২. জগাই আর মাধাইকে
জগাই আর মাধাইকে অনেকে নামের মিল দেখে ভাই বলে মনে করে। কিন্তু আসলে তারা ভাই নয়, বন্ধু বলা যায়। জগাইয়ের নাম জগন্নাথ, আর মাধবের নাম মাধবচন্দ্র। পদবিও আলাদা-আলাদা। জগাই আগে গঞ্জে গামছা বিক্রি করত। মাধাইয়ের ছিল আয়না, চিরুনি, চুলের ফিতে ফিরি করে বেড়ানোর ব্যবসা। কোনওটাতেই সুবিধে হচ্ছিল না বলে একদিন দুজনে একসঙ্গে বসে ভাবতে শুরু করল। ভেবেটেবে দু’জনে মোট দু’শো সাতাত্তর টাকা খরচ করে তেলেভাজার দোকান দিল, আর ভগবানও মুখ তুলে চাইতে লাগলেন। আশপাশে ফুলুরি-বেগুনির বিস্তর দোকান থাকা সত্ত্বেও জগাই-মাধাইয়ের দোকান ঝমাঝম চলতে লাগল। এক-একদিন দু’ তিনশো টাকা বিক্রি। মাথাপিছু নিট আয় দিনে একশো-দেড়শোয় দাঁড়িয়ে গেল। ব্যবসা যখন জমে গেছে ঠিক সেই সময়েই একদিন সদলবলে পানুবাবু এসে হাজির। পানুবাবুর বাবরি চুল, জম্পেশ গোঁফ, গালপাট্টা, গায়ে গিলে করা পাঞ্জাবি, পরনে ময়ূর ধুতি, পায়ে দামি চপ্পল। সাতটা গাঁয়ের লোক পানুবাবুকে যমের মতো ভয় করে। শালপাতার ঠোঙায় দলবল নিয়ে বিস্তর তেলেভাজা সেঁটে “বেশ করেছিস তো” বলে পানুবাবু দাম না দিয়েই উঠে পড়লেন। বললেন, “আমার নজরানা দেড়শো টাকা ওই পটলার হাতে দিয়ে দে।”
না দিয়ে উপায় নেই। জগাই-মাধাইও দিল। প্রথম প্রথম সপ্তাহে একদিন-দু’দিন এরকম অত্যাচার চলতে লাগল। মাসখানেক বাদে সপ্তাহে চার-পাঁচ দিন। রোজ যে পানুবাবু আসতেন তা নয়। তাঁর দলবল দশ-বারোজন এসে হামলা করত। মোড়ল-মাতব্বর ধরেও লাভ হল না। গঞ্জের সব ব্যাবসাদারকেই ভোলা দিতে হয় বটে, কিন্তু জগাই-মাধাইয়ের উপর অত্যাচারটা যেন একটু বাড়াবাড়ি রকমের। তা বেচারারা আর কী করে, দোকানটা তুলেই দিল। ফের দু’জনে ভাবতে বসল। ভেবেটেবে দু’জনে মিলে একটেরে ছোট্ট একখানা মনিহারি দোকান খুলল। খুলতে না-খুলতেই পানুবাবুর দলবল এসে হাজির। তারা ধারে জিনিস নিতে লাগল টপাটপ। তোলা আদায় তো আছেই।
জগাই-মাধাই ফের পথে বসল। কেন যে পানুবাবু তাদের মতো সামান্য মনিষ্যির সঙ্গে এমন শত্রুতা করছেন তা বুঝতে পারছিল না।
মাধাই বলল, “বুঝলি জগাই, এর পিছনে ষড়যন্ত্র আছে। কেউ পানুবাবুকে আমাদের উপর লেলিয়ে দিয়েছে।”
“সেটা আমিও বুঝতে পারছি। শেষে কি গঞ্জের বাস তুলে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে?”
“তাই চল বরং। গঞ্জ ছেড়ে ছোটখাটো কোনও গাঁয়ে গিয়ে ব্যবসা করি। বড় বড় মানুষ বা ষণ্ডা-গুন্ডাদের সঙ্গে কি আমরা পেরে উঠব? আমাদের না আছে গায়ের জোর, না মনের জোর,না ট্যাঁকের জোর।”
“তা ছাড়া আর একটা জোরও আমাদের নেই। বরাতের জোর।”
“ঠিক বলেছিস।”
“তা হলেই ভেবে দ্যাখ, নতুন জায়গায় গিয়েও কি আমাদের সুবিধে হবে? গাঁয়ের লোক উটকো মানুষ দেখলে হাজারও খতেন নেবে। কোথা হতে আগমন, কী মতলব, নাম কী, ধাম কোথা, মুরুব্বি কে, ট্যাঁকের জোর কত। তারপর গাঁয়ের লোকের নগদ পয়সার জোর নেই, ধারবাকি করে খেয়ে ব্যাবসা লাটে তুলে দেবে।”
মাধাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তা বটে, আমাদের মুরুব্বির জোরও তো নেই। হ্যাঁরে, লটারি খেলবি?”
“বারদশেক খেলেছি। দশবারই ফক্কা।”
“না রে, আমার মাথা ঠিক কাজ করছে না।”
“আমারও না।”
পিছন থেকে কে যেন মোলায়েম গলায় বলে উঠল, “আমার মাথাটা কিন্তু দিব্যি খেলছে।”
দু’জনেই একটু চমকে উঠে পিছন ফিরে চাইল। কিন্তু পিছনে কেউ নেই দেখে মাধাই বলল, “একী রে বাবা! কথাটা কইল কে? ও জগাইদা!”
জগাইও হাঁ হয়ে বলল, “তাই তো! স্পষ্ট শুনলুম।”
একটা গলাখাঁকারি দিয়ে কণ্ঠস্বর ফের বলল, “ঠিকই শুনেছ, ভুল নেই।”
দু’জনের কথা হচ্ছিল ভর সন্ধেবেলা গঞ্জের খালের ধারে ফাঁকা হাটের একটা চালার নীচে বসে। বাঁশের খুঁটির উপর শুধু টিনের চাল। ন্যাড়া ফাঁকা ঘর, কোনও আবরু নেই, হাওয়া বাতাস খেলছে।
মাধাই বলল, “দ্যাখ তো জগাই, টিনের চালের উপর কেউ ঘাপটি মেরে বসে কথা কইছে কি না।”
জগাই দেখেটেখে বলল, “না, চালের উপর তো কেউ নেই।”
গলাটা খিক করে হেসে বলল, “জন্মে কখনও টিনের চালে ওঠার অভ্যেস নেই আমার। বুঝলে!”
মাধাই তটস্থ হয়ে বলে, “আপনি কে আজ্ঞে? দেখতে পাচ্ছি না কেন?”
গলাটা খিঁচিয়ে উঠে বলল, “দেখাদেখির দরকারটা কী? চাই তো বুদ্ধি-পরামর্শ? দেখে হবে কোন কচুপোড়া?”
“আজ্ঞে, ভয়ডরেরও তো ব্যাপার আছে।”
গলাটা ফের খিঁচিয়ে উঠে বলল, “কেন, ভয়ের আছেটা কী? ব্যবসাপত্তর তো লাটে উঠেছে, ভিটেমাটি ছাড়ার জো, এখন আর ভয়টা কীসের শুনি! কথায় বলে ন্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়।”