“চেষ্টা করে দেখব’খন। তা হলে আজ আসি।”
“ওরে বাপু, এত কষ্ট করে পটাশপুরে যে পৌঁছোলে তাতে লাভটা কী হল সেটা তো জানা থাকা চাই।”
“লাভ-লোকসান ঠিক বুঝতে পারছি না। মাথা ঘুরছে।”
“ওহে বাপু, ওখানেই তো সনাতন ওস্তাদের বাস।” নবীন অবাক হয়ে বলল, “সনাতন ওস্তাদ! সে আবার কে?”
“তুমি দেখছি বড্ড আহাম্মক হে! সনাতন লেঠেলের কথাতেই তো পটাশপুরের কথা উঠল।”
“তা বটে। কিন্তু কথাটা উঠছে কেন?”
“উঠবে না! যেখানেই লাঠি সেখানেই সনাতন ওস্তাদের কথা। ভূ-ভারতে ওরকম লাঠিয়াল পাবে না। যদি লাঠিবাজিই করতে চাও তবে একবার পটাশপুরে গিয়ে সনাতন ওস্তাদের আখড়ায় তালিম নিয়ে এসো। লাঠি কীভাবে ধরতে হয়, সেটা শিখতেই ছ’মাস লাগে। লাঠি দেখতে নিরীহ ঠ্যাঙা, কিন্তু ওনার হাতে পড়লে বন্দুকের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে। তাই বলছিলুম–”
নবীন উঠে পড়ল। বলল, “কে বলেছে মশাই, যে আমি লাঠিখেলা শিখতে চাই? আমার পটাশপুরে যাওয়ারও ইচ্ছে নেই, সনাতন ওস্তাদের কাছে তালিম নেওয়ারও দরকার নেই। বুঠমুট আমার খানিকটা সময় নষ্ট করলেন।”
লোকটা সরু চোখে চেয়ে বলল, “তোমার ভালর জন্যই বলছিলাম বাপু। ট্যাঁকে না তোক হাজারত্রিশেক টাকা নিয়ে রাতবিরেতে ভুরফুনের মাঠ পেরোতে হলে শুধু ভগবানের ভরসা না রাখাই ভাল। তা হাতের লাঠিখানা যদি চালানোর বিদ্যে জানা থাকত তা হলে খারাপটা কী হত শুনি!”
নবীন হাঁ। বাস্তবিক আজ তার গেজেতে ত্রিশ হাজার টাকার মতোই আছে। যে খবর এ লোকটার জানার কথা নয়। তার উপর সে যে ভুরফুনের মাঠ পেরোবে সে খবরই বা এ রাখে কোন সুবাদে! চোর ডাকাত নয় তো!
লোকটা যেন তার মনের কথা শুনতে পেয়ে বলল, “না হে বাপু, আমি চোর-ডাকাতও নই, তাদের আড়কাঠিও নই। তবে কিনা তাদের খুব চিনি। চারদিকেই আড়ে-আড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সব। চেনার জো নেই। দেখার চোখ থাকলে অবশ্য ঠিকই দেখতে পেতে।”
নবীন একটু ভড়কে গিয়েছিল। গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, “আ আপনি কে বলুন তো!”
লোকটা চারখানা জিলিপির ফরমাশ দিয়ে নবীনের দিকে চেয়ে নিমীলিত নয়নে নরম গলায় বলল, “সে খতেনে বাপু তোমার কাজ কী? আমি হলুম গে ভবঘুরে মানুষ। মানুষজন দেখে বেড়ানোই কাজ। ওই যে সবুজ জামা পরা লোকটা তোমার পিছনের টেবিলে বসে চপ খাচ্ছিল তাকে লক্ষ করেছ?”
“আজ্ঞে না।”
“তবে তো তোমার চোখ থেকেও নেই। অমন দিনকানারাতকানা হলে গাঁট তো যাবেই, প্রাণটা নিয়েও টানাটানি হতে পারে। শুধু লাঠি চমকালেই তো হবে না। চোখ, মগজ, হুশ এগুলো যদি কুলুপ এঁটে রাখো, তবে লড়বে কীসের জোরে? মানুষের আসল অস্তরই তো ওগুলো। বলে রাখলুম, সবুজ জামা কিন্তু তোক ভাল নয়। তোমার উপর নজর রাখছে।”
নবীন শুকনো মুখে ফের ধপাস করে বসে পড়ে বলল, “তা হলে কী করা যায় বলুন তো!”
“দাঁড়াও বাপু, দাঁড়াও। জিলিপিটা আগে শেষ করি, তারপর ভেবে বলব।”
“কিন্তু আমার যে বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে! হরিপুরে আজ যাত্রার আসর কিনা! আমিই যে ক্লাবের সেক্রেটারি।”
লোকটা সরু চোখে চেয়ে তাচ্ছিল্যের গলায় বলল, “যাত্রা! তা কী পালা হচ্ছে?”
“আজ্ঞে, নতুন একটা সামাজিক পালা, “ওগো বধূ সুন্দরী।”
“দুর দুর, ওসব ম্যাদামারা পালা দেখে জুত নেই।”
“আজ্ঞে, পালাটা খুব নাম করেছে। চিতপুরের দল। অনেক টাকার বায়না।”
লোকটা দ্বিতীয় জিলিপিটায় কামড় বসিয়ে বলল, “ভাল পালা বলছ?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব নাম। বায়না নিতেই চায় না।”
“বলি তলোয়ার খেলা টেলা আছে?”
“তা আছে বোধহয়। আজকাল ঝাড়পিট না হলে লোকে তেমন নেয় না।”
“তা না হয় হল। কিন্তু রাতে খ্যাটনের কী ব্যবস্থা?”
“সে হয়ে যাবে’খন। যাবেন?”
“দাঁড়াও, আগে সব জেনেবুঝে নিই। শোওয়ার ব্যবস্থা কেমন?”
“সেও হয়ে যাবে’খন।”
“আমি ভবঘুরে বটে, কিন্তু গায়ে বনেদি রক্তটা তো আছে। মোটা চালের ভাত, পাশবালিশ ছাড়া ঘুম, ওসব আমার চলবে না।”
“সেসব ব্যবস্থাও হবে। ভাববেন না।”
“তা হলে লাঠিগাছ আমার হাতে দাও। তোমাকে দেখেই বুঝেছি যে তুমি আনাড়ি।”
নবীন মনে একটু জোর পেল। লোকটা রোগাপটকা বটে, কিন্তু পাকানো শক্ত চেহারা। হুঁশিয়ার, পোড়-খাওয়া লোক। চল্লিশ বিয়াল্লিশের মতো বয়স। পরনে খাটো ধুতি, গায়ে সবুজ শার্ট, তার উপর একটা খয়েরি রঙের হাফ সোয়েটার। নবীন লাঠিখানা এগিয়ে দিয়ে বলল, “আপনার নামটা?”
“নিমাই রায়। তুমি নিমাইদা বলেই ডেকো।”
“আমি হলুম নবীন সাহা।”
“আর বলতে হবে না। জটেশ্বর সাহার ছেলে তো? তোমাদের বিস্তর ধানজমি, চাল আর তেলের কল আছে। একটা মুদিখানাও।”
নবীন অবাক হল না। লোকটা হয়তো অন্তর্যামী, সাধক-টাধকদের ওসব গুণ থাকে।
লোকটা ফের যেন তার মনের কথা টের পেয়ে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলল, “না রে বাপু। আমি অন্তর্যামী-টামি নই। তবে আমার বাতিক হল, মানুষের খবর-টবর রাখা। এই গঞ্জের বাজারে যত লোক আনাগোনা করে তাদের প্রায় সবার নাড়িনক্ষত্র আমার নখদর্পণে।”
নবীন নিজের আর নিমাইয়ের খাবারের দামটাও মিটিয়ে দিল। নিমাই বিশেষ আপত্তি করল না।
গঞ্জের সাঁকোটা পেরিয়ে নির্জন মাঠের রাস্তায় পড়েই নবীন হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলে নিমাই বলল, “উঁহু, অত জোরে হেঁটো না। লোকে সন্দেহ করবে। দুলকি চালে হাঁটো, বদমাশরা যাতে বুঝতে না পারে যে ভয় পেয়েছ। ভয় হল মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রুর।”