নবীন একটু পিছনে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। এবার এগিয়ে এসে বলল, “পানুকাকা, ও লাঠিটা আমাদের বাড়ি থেকে চুরি গেছে একটু আগে। আমরা ওটা ফেরত নিতে এসেছি। খামকা এ দু’জন নিরীহ লোককে মারধর করবেন কেন? এরা তো কোনও অন্যায় করেনি। লাঠিটা ফেরত পেলেই আমরা চুপচাপ চলে যাব।”
পানুবাবু ধাতস্থ হয়ে মৃদু হেসে মোলায়েম গলায় বললেন, “ওরে বাপু, লাঠির গায়ে তো কারও নাম লেখা নেই! তুমি ভুল করছ বাপু। এ লাঠি আমার ঠাকুরদার আমলের। একটা স্মৃতিচিহ্ন হিসেবেই যত্ন করে রেখেছিলুম। আজ হরিপুরে যাত্রা শুনতে আসার সময় ভাবলুম, ভুরফুনের মাঠ তো ভাল জায়গা নয়, গুন্ডা বদমাশদের আখড়া। তাই ছড়িটা রেখে লাঠিটা নিয়ে গিয়েছিলুম। এ তোমাদের লাঠি নয় হে।”
নবীন দৃঢ়স্বরে বলে, “না, ও লাঠি আপনার নয়।”
“তবে কি আমি মিথ্যে কথা কইছি হে?”
জগাই বলল, “মাধাইদা, পানুবাবু জানতে চাইছেন উনি মিছে কথা কইছেন কিনা। বড় কঠিন প্রশ্ন। ভেবেচিন্তে জবাব দাও তো!”
মাধাই আঙুল দিয়ে কান চুলকে খানিক ভেবে বলল, “বড় মুশকিলে ফেললি রে জগাই। হঁ্যা বললে পানুবাবুর যে বড্ড মন খারাপ হবে। সেটা কি ভাল হবে রে?”
জগাই মাথা নেড়ে বলল, “সেটাও তো গুরুতর কথা। পানুবাবুর মন খারাপ হলে মাথার ঠিক থাকে না কিনা, হয়তো কেঁদেই ফেলবেন। ভাল লোকদের নিয়ে ওই তো বিপদ।”
পানুবাবু হঠাৎ তবে রে’ বলে লাঠি বাগিয়ে ধরে বললেন, “অনেকক্ষণ ধরে বেয়াদবি সহ্য করেছি। আর নয়!”
কিন্তু লাঠিটা তুলতে গিয়ে পানুবাবুর চোখ ইয়া বড় বড় হয়ে গেল। ভারী অবাক হয়ে বললেন, “একী!”
পানুবাবুর গুন্ডার দল অবশ্য সটান এসে চড়াও হল জগাই আর মাধাইয়ের উপর। শাবল তুলে দু’জনে বিদ্যুতের গতিতে চালাতে লাগল। ঠকঠক ঠনঠন শব্দে কান ঝালাপালা।
নবীন নিঃশব্দে গিয়ে হতবাক পানুবাবুর হাত থেকে লাঠিটা নিয়ে নিল। তারপর শুরু হল লাঠির খেল। সুদর্শন চক্রের মতো নবীনের লাঠি চারদিকে ঘুরতে লাগল। বনবন! বনবন! চোখের পলকে গুন্ডাদের হাতের অস্ত্রশস্ত্র ছিটকে উড়ে যেতে লাগল চারদিকে। ‘বাপ রে মা রে’ চিৎকার করতে করতে কেউ ঠ্যাং ভেঙে, কেউ মাথায় চোট পেয়ে, কেউ হাত ভেঙে ধরাশায়ী হতে লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই লড়াই শেষ। শুধু পানুবাবু ভারী হতবাক আর স্তম্ভিত হয়ে সেই যে দাড়িয়ে পড়েছিলেন আর নড়েননি।
“এ কী রে জগাই, পানুবাবু এখনও দাড়িয়ে যে!”
জগাই কাছে গিয়ে পানুবাবুর মুখখানা ভাল করে দেখে বলল, “তাই তো! এ তো পানুবাবুই মনে হচ্ছে মাধাইদা! নাঃ, পানুবাবুর সাহস আছে। এত কাণ্ড দেখেও পালাননি কিন্তু।”
“ওরে ভাল করে দ্যাখ, মূছা গেছে কিনা!”
জগাই মাথা চুলকে বলল, “কিছু একটা হয়েছে। যঁা, মাধাইদা, পানুবাবুকে তুমি মারোনি তো!”
জিভ কেটে মাধাই বলে, “ছিঃ ছিঃ, অত বড় মানী লোকের গায়ে হাত তুলতে আছে? একটু ঠেলা দিয়ে দ্যাখ তো।”
“সেটা কি ভাল হবে মাধাইদা? পড়েটড়ে গেলে যে জামাকাপড় নোংরা হবে।”
“কিন্তু সবাই যেখানে শুয়েটুয়ে আছে সেখানে পানুবাবুর এই একা খাড়া দাড়িয়ে থাকা কি ভাল দেখাচ্ছে?”
“বলছ! তা হলে ঠেলব?”।
একটু ঠেলতেই পানুবাবু ধড়াস করে চিতপাত হয়ে পড়ে গেলেন।
“আহা, ভদ্রলোকদের কি ওভাবে ঠেলতে আছে রে জগাই! মেরে ফেলিসনি তো!”
জগাই পানুবাবুর নাকের সামনে হাত দিয়ে বলল, “না গো মাধাইদা, দিব্যি খাস চলছে।”
তিনজন পাশাপাশি দাড়িয়ে রণক্ষেত্রের করুণ চেহারাটা খানিকক্ষণ দেখে যখন ফেরার জন্য ঘুরে দাঁড়াল, তখনই মৃদু গলাখাঁকারির একটা শব্দ পাওয়া গেল।
এদিক-ওদিক চেয়ে কাউকে দেখা গেল না অবশ্য। জগাই সোৎসাহে বলে উঠল, “কণ্ঠদাদা নাকি?”
“আজ্ঞে না।”
মাধাই বলল, “তা হলে নির্ঘাত কুঁড়োরামদাদা।”
“আজ্ঞে না, আমি কুঁড়োরাম নই।”
নবীন অবাক হয়ে বলে, “তবে আপনি কে?”
“আমি সাধুবাবার এক সেবাইত। তার সমাধিতে হাওয়াটাওয়া করি, পাহারা দিই।”
“আপনাকে দেখা যাচ্ছে না কেন?”
“আমি কি আছি, যে দেখবেন?”
“নেই! তা হলে কথা শুনতে পাচ্ছি যে!”
“আমি আপনাদের মতো নেই, আমার মতো আছি।”
নবীন বলল, “বুঝেছি, আমাদের কিছু বলবেন?”
“সাধুবাবা তাঁর লাঠিখানার জন্য অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছেন।”
নবীন লাঠিখানা তুলে ধরে বলল, “এটাই কি সাধুবাবার লাঠি?”
“হ্যাঁ।”
নবীন বলল, “ওঁর লাঠি উনিই নেবেন। আমাদের আপত্তি নেই।”
একটা বড় শ্বাস ফেলার মতো আওয়াজ শোনা গেল। গলার স্বর বলল, “আজ আমার বুকটা ঠান্ডা হল। ওই বাঁ দিকে দশ কদম এগোলেই যে মাটির ঢিবি দেখতে পাবেন, সেটাই সাধুবাবার সমাধি।”
তারা ধীর পায়ে দশ কদম এগিয়ে গেল। লম্বাটে ঢিবিটার সামনে দাড়াল।
“এবার কী করব?”
“দক্ষিণ শিয়রে লাঠিটা খাড়া করে রাখুন।”
“পড়ে যাবে যে!”
“না, পড়বে না।” নবীন সমাধির দক্ষিণের শিয়রে লাঠিটা দাড় করিয়ে রেখে হাত সরিয়ে নিল। আশ্চর্য! লাঠিটা দিব্যি দাঁড়িয়ে রইল।
.
সেবাইতের কণ্ঠস্বর বলল, “আর দু-চার দিনের মধ্যেই ওই লাঠির গায়ে পাতা গজাবে। ডালপালা বেরোবে … লাঠিটা গাছ হয়ে যাবে। … তারপর কুঁড়ি আসবে … ফুল ফুটবে। সাদা সুগন্ধি ফুল। গাছ কেঁপে ফুল ফুটবে … আর সাধুবাবার সমাধির উপর টুপটাপ করে সারাদিন সারারাত ধরে ঝরে পড়বে সাদা সুগন্ধি ফুল। … আর সাধুবাবা সমাধিতে বড় শান্তিতে ঘুমোবেন তখন … বড় শান্তি …”