শ্রীনাথের অবাক হওয়ার কারণ আছে। হিরুর দলে সে-ই সবচেয়ে বড় লেঠেল। হিরুর চেয়েও ভাল, গোটা জেলায় তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার কেউ নেই।
শ্রীনাথ গম্ভীর মুখে বলল, “ওস্তাদ, তুমি যা পেয়েছ তার দাম লাখ টাকা।”
হিরু তৃপ্তির হাসি হেসে লাঠিটা কাঁধে তুলে বলল, “চল! দুনিয়া এখন আমার হাতের মুঠোয়।”
হঠাৎ সামনের অন্ধকার কুঁড়ে একটা জোরালো টর্চের আলো এসে পড়ল হিরুর মুখে। কে যেন গর্জন করে উঠল, “শাব্বাশ!”
পালটা গর্জন ছেড়ে হিরু বলল, “কে রে? কার এত সাহস যে, আমার মুখে আলো ফেলিস!”
টর্চের পিছন থেকে গ্যানা বলল, “নড়িসনা হিরু, তোর দিকে বন্দুক তাক করা আছে। লাঠিটা সামনে মাটিতে রেখে পিছু সরে যা।”
হিরু ফের আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে অট্টহাসি হাসল। বলল, “আমাকে বন্দুক দেখাচ্ছিস রে গ্যানা? বন্দুক! আয় তবে, আমার খেলও একটু দেখে নে!”
বলে হিরু লাঠিটা তুলতে গিয়ে হঠাৎ বোকা বনে গেল। একী রে বাপ! লাঠি তো বিশমনি পাথরের মতো ভারী! তোলা দূরের কথা, নড়ানোই যাচ্ছে না যে! ধস্তাধস্তিতে কপালে এই শীতেও ঘাম ফুটে উঠল হিরুর। তবু লাঠি নড়ল না। হ্যাঁচকা টান দিয়ে শেষ চেষ্টা করতে গেল হিরু, আর তখনই দুম করে বিকট আওয়াজে গ্যানার বন্দুক থেকে গুলি ছুটল। সোজা এসে বিঁধল তার বাঁ কাঁধে, বাপ রে বলে লাঠি ছেড়ে কাঁধ চেপে বসে পড়ল হিরু। আর সেই সুযোগে গ্যানার। দলবল চড়াও হল হিরুর দলের উপর। মশাল আর টর্চের আবছা আলোয় ধুন্ধুমার চলতে লাগল দুই পক্ষে। মাঝে মাঝে বন্দুকের শব্দ, ধোঁয়া আর বারুদের গন্ধ।
কী যে হল, কে জিতল, কে হারল তা বুঝবার উপায় রইল না কিছুক্ষণ। তারপর দেখা গেল মাঠময় ত্রিশ-চল্লিশজন লোক নিথর হয়ে পড়ে আছে।
আর এই সময়েই নিজের কুখ্যাত বাহিনী নিয়ে অকুস্থলে হাজির হলেন পানুবাবু। এতক্ষণ একটু আবডালে অপেক্ষা করছিলেন, ঘটনা কোন দিকে মোড় নেয় তা দেখার জন্য।
একটু মিচকি হাসি হেসে তিনি পড়ে-থাকা হিরুর দুর্বল মুঠো থেকে আলগোছে লাঠিটা তুলে নিলেন। টর্চের আলোয় ভাল করে নিরীক্ষণ ৮৮
করে তিনি স্বগতোক্তি করলেন, “এই লাঠিখানার জন্য এত পেরামনি গেল তোদের, তবু ভোগে লাগল না রে!”
ধুতি-পাঞ্জাবি পরা ফুলবাবুটি হলেও পানু ঘোষ একসময়ে যে ওস্তাদ লেঠেল ছিলেন তা সবাই জানে। লাঠিখানা হাতে নিয়ে তিনি পাখসাট মেরে কয়েক মিনিট বিদ্যুতের গতিতে লাঠিখানা চালালেন। তারপর অবাক হয়ে বললেন, “এ তো সাঙ্ঘাতিক জিনিস! এ লাঠি তো চালাতেও হয় না, আপনি চলে!”
পানুবাবুর গুন্ডারা সভয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিল। পানুবাবু চারদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “চল রে, আমার আবার বেশি রাতে ঘুমোলে পেটে বায়ু হয়।”
“তা হলে চললেন নাকি পানুবাবু!”
পানু ঘোষ দেখল, তিনটি আবছা মূর্তি সামনে পথ জুড়ে দাঁড়ানো। মরা চোখে চেয়ে পানুবাবু সস্নেহে বললেন, “তোরা কারা রে? কী চাস?”
একটু এগিয়ে এসে জগাই হাতজোড় করে বলল, “এই আমরা পানুবাবু। আপনার চাকরবাকরও বলতে পারেন, প্রজাও বলতে পারেন।”
মশালের আলোয় মুখখানা নিরীক্ষণ করে পানুবাবু বললেন, ”মুখখানা চেনা-চেনা লাগছে বটে! গঞ্জে তোদের তেলেভাজার দোকান ছিল না?”
মাধাইয়ের দিকে চেয়ে জগাই গদগদ গলায় বলল, “বলেছিলাম না মাধাইদা, আমাদের পানুবাবুর স্মরণশক্তি খুব পরিষ্কার। গরিবদেরও মনে রাখেন ঠিক। আর রাখবেনই বা না কেন! উনি তো গরিবের মা বাপ।”
মাধাই হাতের শাবলখানায় একটু হাত বুলিয়ে বলল, “ওরে, পানুবাবুর কি গুণের লেখাজোখা আছে! পানুবাবুকে শ্রদ্ধার সঙ্গে জানিয়ে দে যে, গঞ্জে আমাদের তেলেভাজার একটা দোকান ছিল বটে, তবে পানুবাবু আর তাঁর সাঙাতরা ভারী আদর করে আমাদের তেলেভাজা খেতেন তো, আপনজন মনে করে লজ্জায় দামটা আর সাধতেন না। আমরা অবশ্য তাতে ধন্যই হতুম। তা ধন্য হতে হতে আমাদের তবিল ফাঁক হয়ে গেল কিনা। তা ছাড়া ওঁর নজরানাও তো একটু উঁচু দরেই বাঁধা ছিল। তাই দোকানটা ওঁর দয়ায় উঠে গেছে।”
জগাই ভারী অভিমানের গলায় বলে, “দ্যাখো মাধাইদা, ওইটেই তোমার দোষ। বড় বড় মানুষদের সঙ্গে কথাই কইতে শিখলে না! দেখছ না, বাবু এখন একটা গুরুতর কাজে ব্যস্ত আছেন! এসব ছোটখাটো কথা কয়ে কি ওঁর মূল্যবান সময় নষ্ট করা উচিত?”
পানু ঘোষ ভুটা একটু কুঁচকে বললেন, “কী বলতে চাস তোরা বল তো! গঞ্জের বাজারে ব্যবসা করবি আর মানীর সম্মানীদক্ষিণা দিবি না?”
মাধাই ভারী অবাক হয়ে বলল, “এই দ্যাখো, তাই কি বললুম? আপনার ইচ্ছেতেই তো চন্দ্র-সূর্য আজও উঠছে! আমরা না দিলে আপনার চলবেই বা কীসে? প্রজারা খাজনা দিলে তবে তো রাজাগজাদের বারফট্টাই! এই ধরুন গিলে করা পাঞ্জাবি, কাঁচি ধুতি, দামি শাল, এসব তো আকাশ থেকে পড়বে না। তা পানুবাবু, আপনার সেই রুপো বাঁধানো ছড়িখানা কোথায় গেল বলুন তো! সেটা ছেড়ে। এমন একখানা কী বিচ্ছিরি বাঁশের লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন যে বড়! ও কি আপনাকে মানায়? দিন, দিন, ওসব লাঠি এই আমাদের মত ছোটলোকের হাতেই খাপ খায়।”
পানুবাবু হঠাৎ ‘খবরদার’ বলে একটা বিকট চিৎকার করলেন। তারপর তাঁর সাঙাতদের দিকে ফিরে বললেন, “দে তো ধরে দু-চার ঘা। বড় বাড় বেড়েছে দেখছি!”