নিমাই টক করে দাড়িয়ে বলল, “তাই নাকি?”
“সমাধি বলে চেনা যায় না বটে। মাটিতে ঢেকে গেছে তো!”
নিমাই এদিক-ওদিক চেয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে বলল, “কথাটা কে বললে হে? কাউকে দেখছি না যে!”
“তাজমহল তো আর নই রে বাপু, দেখার কী আছে?”
দুনিয়াটা বাজে লোকে ভরে গেছে। কার যে কী মতলব তা বোঝা কঠিন, তাই লাঠিটা শক্ত করে বাগিয়ে ধরে ফের চারদিকে। ভাল করে চেয়ে দেখে নেয় নিমাই। তারপর বলে, “মতলবটা কী তোমার ?”
“মতলব কিছু খারাপ দেখলে নাকি?”
“লোকটাই বা তুমি কে?”
“এই এখানেই বহুকাল বসবাস। এই সাধুবাবার সমাধিতে হাওয়াটাওয়া করি, পাহারা দিই।”
“তা তো বুঝলুম, কিন্তু গা-ঢাকা দিয়ে আছ কেন?”
খুক করে হেসে লোকটা বলল, “ঢাকবার মতো গা কোথায় হে! তা সে যাক গে, সাধুবাবার লাঠিটা নিয়ে এসেছ দেখছি! নিবেদন করবে নাকি?”
“লাঠি! না না, এ সাধুবাবার লাঠি নয়। এ আমার লাঠি।”
একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হল। লোকটা খানিক চুপ করে থেকে বলল, “তাই হবে বোধ হয়। কে যে কীসের মালিক তা আর আজকাল বুঝবার উপায় নেই কিনা। তবে কী জানো, যার কর্ম তারে সাজে, অন্যের হাতে লাঠি বাজে।”
কথাটার মধ্যে একটু যেন ঘোরপ্যাচ আছে! নিমাই সেটা ধরতে পারল না। বলল, “সাধুবাবা কে হে? গুনিনটুনিন ছিলেন নাকি?”
“সাধু মহাত্মাদের কথা কি নাংলা ভাষায় কওয়া যায়? আর কইলেও তুমি বুঝতে পারবে কি?”
পরিস্থিতিটা নিমাইয়ের খুব সুবিধের বলে মনে হচ্ছিল না। সে লাঠিখানা কাধে ফেলে পা বাড়িয়ে বলল, “চলি হে! তুমি বরং তোমার সাধুবাবার সমাধিতে ভাল করে হাওয়া দাও।”
“চললে নাকি?”
“হ্যাঁ বাপু। আমার মেলা কাজ পড়ে আছে।”
“তা যাবে যাও, তবে একটু দেখেশুনে যেও। বনকরমচার জঙ্গলের দিকটায় পায়ের শব্দ পেলুম যেন।”
শুনে প্রথমটায় কুঁকড়ে গিয়েছিল নিমাই। তারপর লাঠিটার কথা মনে পড়তেই সোজা হয়ে দাড়াল। ভয়টা কীসের? বরং লাঠির ক্ষমতা একটু যাচাইও হয়ে যাবে। সে হেসে বলল, “ও শিয়ালটিয়াল হবে। ভয় নেই! লাঠি দেখলেই পালাবে।”
লোকটার গলাটা ভারী মিইয়ে গেল, বলল, “পালালেই ভাল।”
নিমাই বেশ বীরদর্পেই হাঁটা ধরল। কিন্তু কয়েক কদম এগোতেনা-এগোতেই অন্ধকার কুঁড়ে দৈত্যদানবের মতো লাঠিধারী জনাবিশেক লোক বেরিয়ে এল। ফস করে একজনের হাতে একটা মশাল জ্বলে উঠে চোখ ধাঁধিয়ে দিল নিমাইয়ের। তবে সেই আলোয় সে হিরু গায়েনের বিশাল কোঁতকা চেহারাটা দেখতে পেল।
হিরু গর্জন করে উঠল, “লাঠি চুরি করে পালাচ্ছিলি রে শিয়াল?”
নিমাই বরাবর মৃদুভাষী। তর্জনগর্জন তার আসেনা। তবে যথাসাধ্য গম্ভীর গলায় নিমাই বলল, “দ্যাখ হিরু, তোর অনেক বেয়াদবি আমি মুখ বুজে সহ্য করেছি। কিন্তু আর নয়। যদি ভাল চাস তো দলবল নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে মাপ চা। মারধর করা আমি পছন্দ করি না। বশ্যতা স্বীকার করে নিলে ঝামেলা করব না। চাই কী আমার দরোয়ানের চাকরিও করতে পারবি। দু’বেলা খাওয়া, পরা, হাজার টাকা মাইনে। খারাপ কী বল! নে নে, আর দেরি করিস না। রাত হয়ে যাচ্ছে। হাতে আমার মেলা কাজ।”
হিরু এত অবাক হল যে, প্রথমটায় কিছুক্ষণ কথাই কইতে পারল না। তারপর হঠাৎ বিকট জোরে এমন অট্টহাস্য করে উঠল হাহা করে যে, গাছগাছালিতে পাখিরা প্রাণভয়ে চেঁচামেচি করে ওড়াউড়ি শুরু করল পাগলের মতো।
নিমাই কাঁধ থেকে লাঠিটা নামিয়ে দু’হাতে তুলে ধরতে গিয়ে হঠাৎ টের পেল, লাঠিটা যেন ভারী-ভারী লাগছে! আঁ! এত ভারী হওয়ার তো কথা নয়! হঠাৎ লাঠির ওজনটা এত বেড়ে গেল কেন রে বাবা! নিমাই দু’হাতে বেজায় শক্ত করে ধরে লাঠিটা যতই তুলতে চায় ততই যেন লাঠিটা মাটির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ওজনটা কি আরও বেড়ে গেল নাকি? ইঃ রে বাবা, এ তো মোটে তোলাই যাচ্ছে না আর! লাঠির উপর যেন হিমালয় পর্বত চেপে বসছে!
হিরু দাঁত বের করে ধীর কদমে এগিয়ে আসে।
দাঁতে দাঁত ঘষে বলে, “রাতারাতি বীর হয়ে গেলি নাকি রে নিমাই? আঁ! আবার তুই তোকারি করা হচ্ছে! বুকের এত পাটা হয়েছে যে, আমাকে দরোয়ান রাখতে চাইছিস! সাপের পাঁচ-পা দেখেছিস রে মর্কট ?”
ধাঁ করে হিরুর লাঠির একটা ঘা এসে পড়ল নিমাইয়ের কোমরে। বাপ রে বাপ’ চেঁচিয়ে চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল নিমাই। তবু সেই অবস্থাতেই লাঠিটা আর একবার তুলবার চেষ্টা করল সে। কিন্তু লাঠি নড়াতেই পারল না।
পর মুহূর্তেই ঝপাঝপ আরও লাঠি এসে পড়তে লাগল বৃষ্টির মতো। কিছুক্ষণ বাপ রে, মা রে’ বলে চেঁচাল নিমাই। তারপর মাথা ঝিমঝিম আর চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
তার শিথিল হাত থেকে লাঠিটা তুলে নিল হিরু। চমৎকার লাঠি, এ লাঠি চালিয়ে সুখ আছে। তার উপর মন্তরের জোর। এ লাঠি দিয়ে দুনিয়া বশ করা যায়। নিমাইয়ের মতো বেল্লিকের হাতে কি এ জিনিস মানায়?
একটা হাঁকাড় ছেড়ে লাঠিটা দু’হাতে তুলে একটু ঘুরিয়ে দেখল হিরু, বাপ রে, এ যে লাটুর মতো ঘোরে! আশ্চর্য কাণ্ড তো! এ লাঠিতে যে সত্যিই জাদু আছে, হিরু তার এক সাঙাতকে ডেকে বলল, “আয় তো শ্রীনাথ, একটু মহড়া নে তো!”
কিন্তু মহড়া নেবে কী? প্রথম টক্করেই শ্রীনাথের হাতের লাঠিটা উড়ে বিশ হাত দূরে গিয়ে পড়ল। শ্রীনাথ বেকুবের মতো তাকিয়ে বলল, “একী রে বাবা!”