আঁচিয়ে এসে দু’জনে যখন বারঘরে পাতা বিছানায় শুতে যাবে তখনই শোরগোলটা উঠল, “আগুন! আগুন!”
বেরিয়ে এসে খড়ের গাদায় আগুন দেখে দু’জনেই অবাক। তারা গাঁয়েরই লোক। খড়ের গাদার আগুন তারা খুব চেনে। এ বড় সাঙ্ঘাতিক আগুন।
দু’জনে তিলার্ধ দেরি না করে শাবল দুখানা নিয়ে ছুটে গেল। গাঁ বাঁচাতে গাঁয়ের লোকও ছুটে আসছে।
পেট ঢাঁই হয়ে আছে। তা সত্ত্বেও জগাই খড়ের গাদার মাথায় উঠে পড়ল হাঁচোড়পাঁচোড় করে। বাঁশের খুঁটিতে গাদার বাঁধন খুলে দিতেই গাদার খড় ভেঙে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। আগুন আর বিশেষ সুবিধে পেল না। মাটিতে ছড়ানো জ্বলন্ত খড় নিভিয়ে ফেলা শক্ত কাজ নয়।
নবীন আর তার বাপ-খুড়োরা এসে খুব বাহবা দিল দু’জনকে। বলল, “তোমাদের যেমন সাহস, তেমনই বুদ্ধি আর তেমনই ভাল মানুষ তোমরা।”
দু’জনে লজ্জায় নতমুখ। মাধাই বলে, “কী যে বলেন বাবুরা, আমরা আবার মনিষ্যি!”
জগাই লাজুক গলায় বলল, “ভাল ভাল কথা শুনতে মন্দ লাগে না বটে কর্তা, তবে কী জানেন, আমরা ঘোটলোক তো, ওসব শুনলে আবার পাপ না হয়ে যায়।”
নবীনের জ্যাঠা পরমেশ্বর সাহা হেসে বলল, “পাপ হবে কেন হে? হক কথাই তো কইছি বাপু। তোমাদের দু’জনকে আমাদের ভারী পছন্দ হয়েছে। হরিপুর থেকে তোমাদের আর যেতে দিচ্ছি না।”
শুনে জগাই-মাধাই দু’জনেরই মুখ শুকনো।
মাধাই আমতা আমতা করে বলল, “আজ্ঞে, প্রস্তাব তো খুবই ভাল, কিন্তু আমাদের এ জায়গা মোটেই পছন্দ হচ্ছে না যে!”
জটেশ্বর অবাক হয়ে বলে, “বলো কী? দশটা গাঁ ঘুরে এসো, সব জায়গায় হরিপুরের সুখ্যাতি শুনবে। লোকে বলে, লক্ষ্মী গাঁ, এখানকার মাটি ভাল, জলবায়ু ভাল, মানুষ ভাল।”
জগাই কাতর গলায় বলে, “কিন্তু হজমের বড্ড গোলমাল হচ্ছে যে!”
নবীনের কাকা হরেশ্বর নাটকটাটক করে। সে রাবণের কায়দায় হাহা করে হেসে বলে, “শোনো কথা! হরিপুরে নাকি হজম হয় না। ওরে বাপু, সকালের জলখাবারের যদি আস্ত একটা হাতিও গিলে ফ্যালো তো দুপুরে এমন খিদে পাবে যে, এক গণ্ডা গন্ডারেও খিদে মিটবে না।”
মাধাই একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে, সে কথাটাই তো বলার চেষ্টা করছি। এখানকার জল খুব খারাপ। খাবারদাবার মোটে পেটে তিষ্টোতে পারে না। সেজগিন্নিমাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন, আধঘণ্টা আগে গাণ্ডেপিণ্ডে খেয়ে উঠেছি, এখনই পেট যেন হুহু করতে লেগেছে। এরকম হলে তো আমাদের মতো গরিব মনিষ্যির বড়ই বিপদ!”
পরমেশ্বর মাথা নেড়ে বলল, “বুঝেছি। তা বাপু, কথাটা মিথ্যেও নয়। হরিপুরে একটু খিদের উৎপাত আছে বটে। তবে ভেবোনা, ওসব সমস্যার সমাধান আমরা করে দেব। আপাতত কিছুদিন আমাদের বাড়িতেই আস্তানা গাড়ো, আমরাও একটু অতিথিসেবা করি। তারপর তোমাদের ব্যবসাপত্তরের ব্যবস্থা হবে।”
ঠিক এই সময়ে নবীন দৌড়ে এসে বলল, “সর্বনাশ হয়ে গেছে। জ্যাঠা! লাঠিটা চুরি হয়ে গেছে!”
সবাই সমস্বরে বলে ওঠে, “সেকী! কে চুরি করল?”
নবীন বলে, “প্যাংলা বলছিল, আগুন লাগার পরেই নাকি ঢ্যাঙা মতো একটা লোককে দেখেছে লাঠিটা নিয়ে দৌড়ে বাগানে ঢুকে গেল। আমার সন্দেহ, এ হল নিমাই রায়ের কাজ। নির্ঘাত বাগান। পেরিয়ে ভুরফুনের মাঠে ঢুকেছে।”
শাবল দুটো তুলে নিয়ে জগাই আর মাধাই বলল, “তা হলে চলুন, ও ব্যাটার কাছ থেকে জিনিসটা কেড়ে নিয়ে আসি।”
বড়জ্যাঠা ফণীশ্বর বলল, “রোসো বাপু, রোসো। ও লাঠির মোকাবিলা করার ক্ষমতা কোথায় তোমাদের? শেষে বিপদে পড়ে যাবে যে!”
জগাই একগাল হেসে বলল, “ভাববেন না জ্যাঠাকর্তা, আমরা দু’জন তো আজ মরতেই বেরিয়ে পড়েছিলুম। তা কাজটা এখনও হয়ে ওঠেনি। এবার যদি মরি তা হলে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে।”
ফণীশ্বর মাথা নেড়ে বলে, “না না, ওটা কাজের কথা নয়, মরায় কোনও বাহাদুরি নেই। জেনেশুনে ওই কালান্তক লাঠির মোকাবিলা কেউ করে?”
নবীন হতাশ গলায় বলে, “তা বলে লাঠি উদ্ধার হবে না? ওর ভিতরে যে মন্তরের শব্দ হয়! ও লাঠি যে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে!”
ফণীশ্বর বলল, “তা হলে আমাদের দলবেঁধে যাওয়া উচিত। হেঁকেডেকে লোক জড়ো করো। তারপর সবাই মিলে যাই চলল।”
ভুরফুনের মাঠ বড় ভুলভুলাইয়া জায়গা। ঝোপঝাড়ের আড়ালে আবডালে জলায়-জঙ্গলে কত যে গোলকধাঁধা তার হিসেব নেই। একবার দিশা হারিয়ে ফেললে ঘুরে-ঘুরে মরতে হয়। তার উপর ঘন ভূতুড়ে কুয়াশায় চারদিকটা এমন আবছায়া যে, পুব-পশ্চিম-উত্তর দক্ষিণ কিছু ঠাহর করার উপায় নেই।
নিমাই অবশ্য তাতে ঘাবড়ায়নি। বরং সে খানিকটা স্বস্তিই বোধ করছে। যদি কেউ পিছু নেওয়ার মতলব আঁটে তবে হয়রান বড় কম হবে না। রাতবিরেতেই তার যতেক কাজকর্ম, কাজেই নিশুত রাতকে সে বন্ধুলোক বলেই ভাবে। রাত যত নিশুত হয়, অন্ধকার যত আঁট হয়ে চেপে বসে ততই কাজের সুবিধে।
তবে আজ ধকলটাও গেছে বড় কম নয়। বিকেলের কচুরি-জিলিপি কখন তল হয়ে গেছে। তার উপর হাঁটাহাঁটি, লাঠালাঠি, ঠেলাগুঁতো, ঝাপড়-লাথিও বড় কম জোটেনি কপালে। মানুষের শরীর তো! চোর উঁচড় বলে তো আর লোহালক্কড় নয়। তাই আবছায়াতে একটা ঢিবির মতো জায়গা দেখে জিরোনোর জন্য বসতে যাচ্ছিল নিমাই।
মৃদু একটা গলাখাঁকারি দিয়ে কে যেন মোলায়েম স্বরে বলে উঠল, “কাজটা কি ঠিক হবে? ওটা যে সাধুবাবার সমাধি।”