আড়াল থেকে মওকা বুঝে শিয়ালের মতো ছুটে এসে লাঠিটা তুলে বাগানে ঢুকে পড়ল নিমাই। তারপর পিছনের বেড়া ডিঙিয়ে কাঁচা নালাটা পার হয়ে ভুরফুনের মাঠ বরাবর হাটা দিল। না, আর ভয় নেই। মন্ত্রপূত লাঠিখানা হাতে এসে গেছে। এখন সে পরগনার রাজা। আর শিয়ালের মতো ভয়েভয়ে থাকতে হবে না। লাঠির দাপটে টাকাপয়সার লেখাজোখাও থাকবে না তার। ছিচকে চোরের কি কোনও সম্মান আছে সমাজে? গ্যানা বা হিরু গায়েন পথে বেরোলে কেমন মানুষেরা পথ ছেড়ে দেয়। হাতজোড় করে নমস্কারও করে। ‘হেঁ-হেঁ’ করে কত খাতির দেখায়। দোকানদাররা সওদার পয়সা তো নেয়ই না, বরং উলটে দশ-বিশ টাকা প্রণামী দেয়! লাঠির জোরে সে অবশ্য ওদেরও ছাড়িয়ে যাবে। এখন যেমন এ কিলোয়, ও গুতোয়, সে চোখ রাঙায়, তেমনটি আর হচ্ছে না বাবা!
দূর থেকে নবীনদের বাড়ির আগুনটা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল নিমাই। একটু অবাক হল। যতটা লকলক করে উঠে ছড়িয়ে পড়ার কথা ততটা ছড়ায়নি তো! আগুনটা যেন নিবু নিবু! আগুন নিভে গেলেই লোকের খেয়াল হবে যে, লাঠিটা গায়েব। ধাওয়াও করবে বোধ হয় তাকে। তা করুক। এ লাঠি হাতে থাকতে মিলিটারিকেও পরোয়া নেই।
লাঠি কাঁধে নিয়ে বুক চিতিয়ে হাঁটতে লাগল নিমাই।
৫. জড়ো-হওয়া লোকজন
জড়ো-হওয়া লোকজন সব খানিকটা দমে গিয়ে যে-যার ঘরে ফিরে যাচ্ছে। লাঠির মহিমা দেখতে এসে শুধু লাঠিখানা ছাড়া আর কিছুই না। দেখতে পেয়ে অনেকেই বেশ হতাশ। তা ছাড়া লাঠিখানার চেহারাতেও তেমন পালিশটালিশ তো নেই। সাধারণ বাঁশের লাঠি। জগাই বলল, “এসব কথা চাউর হওয়াটা ঠিক হয়নি। ওতে মন্তরের জোর কমে যায়। কী বলো মাধাইদা?”
দু’জনে একটু দূরের একখানা দাওয়ায় অন্ধকারে বসা। মাধাই বলল, “গাঁয়ের লোকের তো পেটে কথা থাকে না কিনা!”
জগাই সায় দিয়ে বলে, “ওইটেই তো হয়েছে আমাদের মুশকিল। মাতব্বর লোকেরা কেমন কথার মারপ্যাঁচ জানে দেখেছ! কতটুকু ছাড়তে হবে, কতটুকু চেপে রাখতে হবে, কোন কথা লাটুর মতো ঘোরাতে হবে, কোন কথা ঘুড়ির মতো ওড়াতে হবে তা ভারী ভাল আঁচ করতে পারে। কথার উপরেই দুনিয়াটা চলছে তো! কথায় পুড়িয়ে দিচ্ছে, কথায় জুড়িয়ে দিচ্ছে।”
মাধাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আমরা তো কথাই কইতে শিখলুম না। যা মনে আসে বলে ফেলি। এই তো সেদিন বড় বড় বেগুনি ভেজেছি, পরেশবাবু এসে বললেন, ‘কেমন বেগুনি ভাজলি রে?”
আমি বলে ফেললুম, “আজ্ঞে চটিজুতোর সাইজ। শুনে পরেশবাবু খাপ্পা হয়ে এই মারেন কি সেই মারেন, আমি তো কথাটা কয়ে ফেলে ভেবেছিলুম বেশ ভাল একটা কথা কয়েছি।”
“না গো মাধাইদা, কথা কওয়াটা শেখা দরকার। এই পরেশবাবুর কথাই ধরো। প্রায়ই এটা শোঁকেন, সেটা শোঁকেন আর বলেন, ‘এঃ, এটায় বোঁটকা গন্ধ, ওটায় টকচা গন্ধ, সেটায় বাসি গন্ধ। পরেশবাবুর গন্ধের জ্বালায় আর পারি না। তা সেদিন বললুম, পরেশবাবু, আপনার নাক বড় হুশিয়ার, কুকুরকে হার মানায়। শুনেই রেগে লাল হয়ে কষালেন এক থাবড়া। কিন্তু তুমিই বলল, যার যেটা ভাল সেটা তো বলাই উচিত, কুকুরের নাক কি ফ্যালনা জিনিস? কথাটা তলিয়ে দেখলে খারাপও কিছুনয়। কিন্তু কথার দোষে কী দাঁড়াল কে জানে!”
“ওরে জগাই, কুকুরের কথায় খেয়াল হল। কোথায় একটা কুকুরছানা কুঁইকুঁই করছে বল তো!”
“আমিও একটা কুঁইকুই শব্দ পাচ্ছি বটে, তবে ভাবলুম বোধ হয়। চড়াইপাখির ছানা ডাকছে। গাঁ-দেশে ওরকম কত শব্দ হয়।”
“তা বটে। তবে শব্দটা কাছেপিঠেই হচ্ছে কিন্তু।”
“আচ্ছা মাধাইদা, ধৰ্মত ন্যায্যত একটা কথা বলবে?”
“কী কথা রে?” “তোমার কি খিদে পাচ্ছে? আমার সন্দেহ হচ্ছে, কুঁইকুই আওয়াজ আমাদের পেট থেকেই হচ্ছে।”
“বলতে একটু বাধো বাধো ঠেকছে রে, ভারী লজ্জাও হচ্ছে। তবে ধৰ্মত বলতে বললি তো, তাই বলছি। খিদেটা কিন্তু নতুন করে হয়নি। ওটা যেন হয়েই আছে, বরং এক কাজ করি আয়। শব্দটাকে। বেড়ালছানার আওয়াজ বলে ধরে নিয়ে চোখ বুজে একটু হরিনাম করি।”
সন্দিগ্ধ গলায় জগাই বলে, “হরিনাম করলে আবার খিদেটা চৌগুণে উঠবে না তো! ঠাকুর-দেবতার নাম নিলে কী থেকে কী হয় কে জানে বাবা!”
“তা সে ভয়ও আছে। হরিনামে খিদে হয় বলেই জানি, তা খিদের উপর যদি আরও খিদে হয় তা হলে বিষে বিষক্ষয় হয়ে যাবে’খন।”
দু’জনে হরিনামই করতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে একটা বাচ্চা মেয়ে এসে বলল, “তোমাদের ভাত বাড়া হয়েছে। মা খেতে ডাকছে।”
ভিতরের দাওয়ায় গিয়ে দু’জনে দেখল, দু’খানা থালায় ভাতের মস্ত দুটো ঢিবি। গিন্নিমা ঘিয়ের বয়াম আর বগি হাতা নিয়ে বসে আছেন। করেন কী, করেন কী’বলতে বলতেই খপাখপ দু’হাতা করে ঘি পড়ল ভাতে। সঙ্গে নুন আর কাঁচালঙ্কা।
“খাও বাবা, তোমরা আমার নবীনের প্রাণরক্ষে করেছ। এ বাড়িতে অতিথি হল নারায়ণ। অতিথিসেবা না হলে বাড়ির বাচ্চাটাও কিছু মুখে দেয় না। তাই তোমাদের একটু আগেভাগে খাইয়ে দিচ্ছি।”
তা খেলও দু’জন। ধুতির কষি আগেই একটু আলগা করে নিয়েছিল। কিন্তু সোনামুগের ডাল পার হতে না-হতেই কষি এঁটে গেল। দুই পদের মাছ আর চাটনির পর যখন জামবাটি-ভরতি নলেন গুড়ের পায়েস টেনে নিল তখন কষি যেন কেটে বসেছে। দমসম অবস্থা। খেয়ে যখন উঠতে যাবে তখন দু’জন মুনিশ এসে দু’দিক থেকে ধরে টেনে তুলল দু’জনকে। নইলে ওঠা মুশকিল ছিল। ভরসার কথা এই যে, দু’জনেই খাওয়ার শেষে হরিপুরের রাক্ষুসে জল একঘটি করে মেরে দিয়েছে।