“ভূগোলে তো দেখছি তুমি খুবই কাঁচা হে।”
“আজ্ঞে, বেজায় কাঁচা।”
“এখান থেকে যদি পুবমুখো রাস্তাটা ধরো তা হলে মাইলপাঁচেক গেলে বিষ্ণুপুর গাঁ। সেখান থেকে বাঁ হাতে যে রাস্তাটা গড়সীতারামপুর গেছে সেটা ধরে ক্রোশ দুই গেলে শ্মশানেশ্বরী কালীমন্দির। ভারী জাগ্রত দেবী, একসময়ে নরবলি হত। সেখান থেকে ডানহাতি কাঁচা রাস্তা ধরে আরও ক্রোশ দুই গেলে বাতাসপুর। বলি বাতাসপুরের নাম শুনেছ?”
“কস্মিনকালেও না।”
“সেখানকার যজ্ঞেশ্বরের মন্দিরের লাগোয়া পুকুরে পাঁচশো হাজার বছর বয়সি ইয়া বড় বড় কাছিম গিজগিজ করছে। এক-দেড় মন ওজন, বাতাসপুরের গুড়ের বাতাসা বিখ্যাত জিনিস, আড়ে-দিঘে এক বিঘত করে, ওজনদার জিনিস।”
“কথাটা হচ্ছিল পটাশপুর নিয়ে।”
“আহা বাতাসপুরে পৌঁছেলে, আর পটাশপুর তো এসেই গেল প্রায়।”
“পৌঁছে গেছি! বাঃ।”
“না হে, পৌঁছোওনি। ওখানে একটি বাধক আছে। বাতাসপুরের ধারেই একটা পাজি নদী আছে। ধলেশ্বরী। চোত-বোশেখে তেমন
তেজি নয়, কিন্তু জষ্টি থেকে মাঘ-ফাল্গুন অবধি একেবারে ভৈরবী। খেয়া পার হওয়াই কঠিন। তা ধলেশ্বরী পেরোলেই নয়াগঞ্জ। দিব্যি জায়গা। রোজ বাজার বসে, বুধবারে হাট, পয়সাওলা লোকের অভাব নেই। নয়াগঞ্জের বেগুন খেয়েছ কখনও? মনে হবে বেগুন তো নয়, মাখন। লোকে বলেও তাই, মাখনি বেগুন।”
“তা বেগুনের পরেই কি পটাশপুর?”
“আরে, অত তাড়াহুড়োর কী আছে? চারদিক দেখতে-দেখতে চাখতে-চাখতে যাওয়াই তো ভাল। নয়াগঞ্জে আমার খুড়শ্বশুরের বাড়ি যে হে। বিশাল তেলের কারবার। মাস গেলে বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা রোজগার। পেল্লায় দোতলা বাড়ি, সঙ্গে আমবাগান। সেখানে দুদিন বডি ফেলে দিলে দিব্যি তাজা লাগবে। যত্নআত্তি করে খুব। দু’বেলা গরম ভাতে ঘি, শেষপাতে ঘন দুধ আর মর্তমান কলা বাঁধা। নয়াগঞ্জ থেকে তোর-ভোর বেরিয়ে পড়লে দুপুর নাগাদ দুধসাগরে পৌঁছে যাবে। দুধসাগরের রাজবাড়ি তো দ্যাখোনি! দেখার মতোই বাড়ি। সাত-সাতটা মহাল। তবে এখন সবই ভগ্নদশা। বুড়ো রাজা এখনও বেঁচে আছেন। মাথায় একটু গণ্ডগোল, সারাদিন বাড়ির আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়ান আর বিড়বিড় করেন। ভাঙা পাঁচিলের ফাঁকফোকর দিয়ে রাজ্যের গোরু-ছাগল ঢুকে রাজবাড়ির বাগানে ঘাস খায়।”
“তা হলে পটাশপুরে আর পৌঁছোনো হল না আজ! আমাকে উঠতে হবে মশাই, একটু তাড়া আছে।”
“আহা, পটাশপুর তো এসেই গেছে হে। দুপুরটা দুধসাগরে জিরিয়ে নাও, তারপর পড়ন্তবেলায় যদি হাঁটা ধরো তা হলে পদ্মপুকুরে পৌঁছোতে সন্ধে। রাতটা জিরেন নাও। পদ্মপুকুর বিরাট গঞ্জ জায়গা। আগরওয়ালাদের ধর্মশালায় দিব্যি ব্যবস্থা। তিন টাকায় শতরঞ্চি আর কম্বল পাওয়া যাবে, সঙ্গে খাঁটিয়া। রাতে তিনটি টাকা ট্যাঁক থেকে খসালে তেওয়ারির হোটেলে চারখানা ঘি মাখানো গরম রুটি আর ঘ্যাঁট পাওয়া যাবে। আর একখানা আধুলি যদি খসাও তা হলে ঘন অড়হরের ডাল। আর চাই কী? তারপর ঘুমখানা যা হবে না, একশো ছারপোকার কামড়ও টের পাবে না।”
“আচ্ছা আচ্ছা মশাই, বাকিটা পরেরবার শুনব’খন। আমাকে এখনই ফিরে যেতে হবে।”
“ওরে বাপু, আমিও কি এই অখদ্দে মাধবগঞ্জে পড়ে থাকব নাকি? আমাকে তো উঠতে হবে হে৷ এখনও তো দেড়খানা জিলিপি তোমার পাতে পড়ে আছে। ওটুকু খেতে-খেতেই আমার কথা ফুরিয়ে যাবে। পদ্মপুকুরের কথা যা বলছিলাম, ওখান থেকে সকালে বেরিয়ে পড়লে পটাশপুর আর কতদূর? মাঝখানে শুধু দোহাটা আর মুগবেড়ে। দোহাটার কথা না হয় আজ থাক। তবে মুগবেড়ে কিন্তু খুব ভূতুড়ে জায়গা। চারদিকে বাঁশবন আর একশো-দেড়শো বছরের বট-অশ্বখ গাছ। দিনের বেলাতেও গা-ছমছম করে। মেলা তান্ত্রিক আর যোগী পুরুষের বাস। যারা ভূতে বিশ্বাস করে না তাদের যদি একবার টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারো, তা হলে দেখবে রাম রাম করে পালাবার পথ পাবে না। সন্ধের পর তো ভূতের একেবারে মোচ্ছ লেগে যায়। চারদিকে ভাম-ম গন্ধ, চিমসে গন্ধ, প্রাণ জল করা হি হি হাসি, খখানা সুরের ফিসফাস। বাপ রে, হাজারে বিজারে অশরীরী।”
“আমার জিলিপি কিন্তু আর আধখানা আছে।”
“ওতেই হবে। একটু চিবিয়ে খাও। মুগবেড়েতে রাতে থাকার সুবিধে নেই, দরকারও নেই। বরং একটু জোর পায়ে হেঁটে জায়গাটা পেরিয়ে গিয়ে এক ক্রোশ দক্ষিণে ছোট পিশুনিয়া গ্রামে দিঘির ধারে গোবিন্দর তেলেভাজার দোকানে বসে একপেট মুড়ি-বেগুনি সাঁটিয়ে নাও। ঘুগনিটাও বড্ড ভাল বানায়। ছোট পিশুনিয়ায় যা খাবে নির্ভয়ে খেতে পারো। শুধু খাওয়ার পর একঘটি জল খেয়ে নিয়ো, ঘণ্টাটাক বাদে পেট খিদের চোটে হাঁচোড়পাঁচোড় করবে।”
“এই যে, জিলিপির শেষ টুকরোটা মুখে দিলাম কিন্তু।”
“আহা, গিলে তো খাবে না হে বাপু। চিবোতে একটু সময় তো লাগবে। তারিয়ে-তারিয়ে খাও। বলছিলুম ছোট পিশুনিয়া থেকে চারদিকে চারটে পথ গেছে। পশ্চিমের পথ ধরে নাক বরাবর দু’ক্রোশ গিয়ে লতাবেড়ের জঙ্গল। ঘাবড়িয়ো না, আজকাল আর বাঘ-ভালুক নেই। কয়েকটা শেয়াল আর এক-আধটা নেকড়ে থাকতে পারে। নির্ভয়ে ঢুকে যাও জঙ্গলে। ঘণ্টাদুই হেঁটে জঙ্গল থেকে বেরিয়েই দেখবে পটাশপুর তোমার জন্য কোল পেতে বসে আছে।”
“যাক বাবা, পৌঁছোনো গেল তা হলে।”
“সবুরে মেওয়া ফলে হে বাপু। এই যে পথটা চিনিয়ে দিলুম, এখন চোখ বুজেও যেতে পারবে।”