ভারী সংকুচিত হয়ে লাজুক হেসে নিমাই বলে, “আজ্ঞে গত অগ্রহায়ণেই করলুম।”
“দ্যাখ নিমাই, তোর নাড়িনক্ষত্র আমি জানি। গত অগ্রহায়ণে তো তুই চুরির দায়ে জেল খাটছিলি?”
জিভ কেটে নিমাই বলে, “ইস, ছিঃ ছিঃ! তাই তো! গত অগ্রহায়ণে নয় তবে! তা হলে বোধ হয় শ্রাবণেই হবে। ঠিক তারিখটা পেটে আসছে, মুখে আসছে না।”
গগন হেসে বলল, “না, শ্রাবণেও নয়, ইহজন্মেও নয়। তোর জন্য ভগবান বউয়ের বরাদ্দই রাখেননি। তিনি বিবেচক মানুষ তো!”
মাথাটাথা চুলকে নিমাই ভারী অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “আজ্ঞে, কেন যেন মনে হচ্ছিল বিয়েটা যেন করেছিলুম। তা মনের ভুলও হতে পারে। ভীমরতিই হল নাকি কে জানে!”
“বালাই ষাট! ভীমরতি তোর শত্তুরের হোক। বিয়াল্লিশ বছর বয়সে তোর ভীমরতি হবে কোন দুঃখে? তা লোকটা কে?”
“আজ্ঞে কার কথা বলছেন?”
“বটতলার অন্ধকারে যার সঙ্গে ফিসফাস করছিলি!”
বড় বড় চোখে চেয়ে তাড়াতাড়ি জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে নিমাই। বলে, “লোক! বড়বাবু, লোক কাকে বলছেন? নমস্য ব্যক্তি, হ্যাঁ বটে, একসময়ে এই আমার-আপনার মতোই মানুষ ছিলেন বটে, তবে গত তিনশো বছর বায়ুভূত হয়ে আছেন। অসুবিধে কিছু নেই। ওই বটগাছের উপরেই দিব্যি ঘরসংসার। দাস-দাসী, পরিবার ছেলেপুলে নিয়ে জাঁকিয়ে আছেন। তা আমাকে দেখে নেমে এসেছিলেন আর কী। এই বলছিলেন, “ওরে নিমাই, অনেকদিন বাদে এলি যে বাপ! কতকাল তোর দেখা নেই?’তারপর একটু সুখ-দুঃখের কথাও হচ্ছিল। সেইটেই আপনি শুনে থাকবেন।”
গগন হেসে বলে, “উপন্যাস লিখলে নাম করে ফেলতিস রে! তা সাব ইনস্পেক্টর কালোবরণ দাসকে মনে আছে? কেমন সুন্দর মারে। বল! রুল দিয়ে এমন এমন জায়গায় ঘা দেয় যে, ব্রহ্মর অবধি ঝংকার তোলে, কিন্তু গায়ে কোথাও মারের দাগটি খুঁজে পাওয়া যায় লো। কালোবরণকে ভুলে গেলি নাকি রে নিমাই? ভুলে গিয়ে থাকলে বল, আজ রাতেই তোকে থানায় নিয়ে গিয়ে পুরনো কথা একটু ঝালাই করে দিই।”
নিমাই তটস্থ হয়ে বলে, “সে কী কথা! কালোবাবুকে ভুলে যাব আমি কি তেমন নিমকহারাম বড়বাবু? তিনি প্রাতঃস্মরণীয় মানুষ। ঘরে-ঘরে ঠাকুরদেবতার ছবির পাশে তাঁর ছবিও রাখা উচিত। অনেকদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই, তাই ভেবেছিলুম কালোবাবু বোধ হয় বদলি হয়ে গেছেন!”
“তাই যেতেন। তবে তোর মায়াতেই বোধ হয় এখনও আটকে আছেন। তা লোকটা কে এবার ভালয়-ভালয় বলে দে বাপু! জানিস ূধ, আমার মোটে খিদে সহ্য হয় না। আজ গোবিন্দপুরের তেজেন তপাদারের মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন যে রে! গলদাচিংড়ি হয়েছে শুনেছি। শুনে অবধি খিদে চাগাড় মারছে। আর খিদে পেলে আমার মাথায় যে খুন চাপে এটা কে না জানে বল!”
নিমাই বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলে, “তা খিদের দোষটাই বা কী বলুন বড়বাবু! সারা পরগনায় আপনাকে কম দৌড়ঝাঁপ করাচ্ছে ওই হিরু গায়েন! শরীরে এক ছটাক মায়াদয়া থাকলে আপনার এই হয়রানি দেখে কবেই ধরা দিয়ে ফেলত! আমরা হলে তো তাই করতুম। ওরে বাপু, সরকার তো আর তোর পর নয়। দেশসুদ্ধ লোককে খাওয়াচ্ছে, পরাচ্ছে, আবদার রাখছে, মায়ের মতোই তো! থানা তো মায়েরই কোল। কিছু খারাপ জায়গাও নয়। কম্বল আছে, দোবেলা দু’থালা ভাত আছে, অসুখ হলে চিকিৎসা আছে, মাথার উপর বাবার মতো বড়বাবু আছেন। ধরা দিতে লজ্জাটা কীসের, ভয়ই বা কী?”
সচকিত গগনদারোগা পিস্তলের খাপে হাত রেখে বলল, “ওঃ, তা হলে লোকটা হিরু গায়েন!”
নিমাই হাতজোড় করে বলল, “অন্ধকারে ঠিক দেখেছি কিনা তা কে জানে বলুন। তবে হাতচারেক লম্বা, দু’হাতের মতো চওড়া পাথুরে চেহারা। হাতে পেতলে বাঁধানো লাঠি।”
দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে গগন বলে, “কী বলছিল শয়তানটা?”
“আজ্ঞে, সে কি আর ভাল শুনেছি, গেলবার বাঁ কান ঘেঁষে কালোবাবু যে থাপ্পড়টা মেরেছিলেন, তারপর থেকেই কানে বড্ড কম শুনছি। হাবেভাবে মনে হল যেন আপনাকেই খুঁজছেন।”
“আমাকে! আমাকে তার কী দরকার? আমিই তো খুঁজছি তাকে!”
“কী যেন বলছিলেন। গোবিন্দপুরে গেনু পালের পোড়োবাড়িতেই। বোধ হয় আস্তানা গাড়বেন আজ। তা আপনিও তো গোবিন্দপুরেই ভোজ খেতে যাবেন। বড়বাবু! বড্ড ভয় হচ্ছে, একটা রক্তারক্তি না হয়ে যায়। তাঁর মতলবটা ভাল বলে মনে হল না। আপনার ভাল-মন্দ কিছু হয়ে গেলে যে আমরা অনাথ হয়ে যাব! গোটা পরগনা পিতৃহীন হবে।”
শেষটা আর শুনতে পেল না গগন, “তবে রে,” বলে ছুটে বেরিয়ে গেল।
নিমাই হাঁফ ছাড়ল। খুচরো ঝামেলায় কাজের বড় দেরি হয়ে যাচ্ছে। এদিক-ওদিক চেয়ে ভাল করে দেখে নিল সে। নবীনদের বাড়িতে বক্তৃতা শেষ হয়েছে। লোকজন যে-যার বাড়ি ফিরছে। চারদিকে একটা আলগা অসাবধানি ভাব। রাস্তাটা পেরিয়ে সেনবীনের বাড়ির পিছন দিকটায় খড়ের গাদার পিছনে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে একটা বিড়ি ধরাল। তার দেশলাইয়ের কাঠিটা না নিভিয়ে খুব যত্ন করে গাদায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে একটু সরে এল। শীতকালের শুকনো বাতাসে আগুনটা ধরেছে বেশ দাউদাউ করে। শিখাটা উপর দিকে উঠলেই কাজ।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই চারদিক থেকে চিৎকার উঠল, “আগুন! আগুন!”
গায়ে আগুন লাগলে এই উত্তুরে বাতাসে সারা গায়েই ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই গা বাঁচাতে হাঁড়ি, কলসি, ঘটি-বাটিতে জল নিয়ে সব লোক ছুটে এল। লাঠিটার কথা কারও খেয়ালই রইল না।