“থাবড়া না খেলে কি মুখ বন্ধ হবে না তোর?”
“উচিত কথাই বলছি। আমরা বলব না তো কি গগনদারোগা বলবে?”
রক্ত-জল করা এক চাউনিতে নিমাই চুপ মেরে গেল। হিরু তেমনই চাপা গলায় বলল, “ও লাঠি আমার চাই, বুঝলি?”
একগাল হেসে নিমাই বলল, “ও তো আপনারই লাঠি! একটা হাঁকাড় ছাড়লেই লোকজন ইঁদুরের মতো পালানোর পথ পাবে না। হাসতে হাসতে গিয়ে তুলে নিন। তারপর লাঠি দোলাতে দোলাতে হেলেদুলে চলে যান। কোথাও আটকাবে না।”
হিরু গর্জন ছেড়ে বলে, “কখনও শুনেছিস, হিরু গায়েন ছ্যাঁচড়ার মতো ছোটখাটো চুরি বাটপাড়ি করেছে কোথাও?”
নিমাই ফের কানে হাত দিয়ে বলে, “কক্ষনও নয়।”
“ওসব তোদের মতো ছুঁচোর কাজ। লাঠিটা আজ রাতেই গোবিন্দপুরের কানু পালের পোড়োবাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবি। সেখানে আমার লোক থাকবে।”
নিমাই এতক্ষণ ধরে মনে মনে ভাবছিল লাঠি হাতে পেলে সে হিরু গায়েনকে দিয়ে কী করাবে। এ লোককে বেশি কাছে ঘেঁষতে দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তবে বাড়ির দরোয়ান করে রাখা যেতে পারে। সে মাথা হেলিয়ে বলল, “এসব ছোটখাটো কাজ আপনাকে মানায়ও না। আপনি বড় বড় কাজগুলো দেখুন, ছোটখাটো কাজ নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না, ওসব আমিই সামলে দেব। তবে হিরুদাদা, এই গরিবের কথাটাও মনে রাখবেন একটু। বেঁচেবর্তে থাকতে আমাদেরও তো একটু সাধ হয় কিনা। পেটটা চলা চাই তো?”
“হ্যাঁ, তবে তার আগে শ্বাসটাও চালু রাখতে হবে তো। লাঠি না পেলে তোর শ্বাসও কিন্তু চলবে না।”
“যে আজ্ঞে। বুঝেছি।”
অন্ধকারে হিরু গায়েন ফট করে অদৃশ্য হয়ে গেল।
পিঠে হিরুর ভারী লাঠির খোঁচা আর কোমরে হিরুর নাগরার লাথি একটু কাহিল করে ফেলেছে তাকে। তবে কি নিমাইয়ের সবই সয়। একটু কেতরে সে উঠে দাঁড়াল। হাতে মেলা কাজ। লাঠির উমেদার যে হারে সংখ্যায় বেড়ে চলেছে তাতে তাড়াতাড়ি বাগাতে না পারলে বেহাত হতে কতক্ষণ! উঁকি মেরে সে দেখল, এখনও নবীনদের বাড়িতে মেলা ভিড়। গোটাচারেক হ্যাজাক জ্বালানো হয়েছে। কে যেন হেঁড়ে গলায় লাঠির মহিমা বিষয়ে একটা বক্তৃতাও দিচ্ছে। নিমাই কান পেতে শুনল, হেঁড়ে গলাটা বলছে, “ভাইসব, বন্ধুগণ, মা ও বোনেরা, লাঠিই বাঙালির সনাতন ঐতিহ্য, লাঠিই আমাদের পুরনো বন্ধু এবং পরমাত্মীয়ও বটে। যেদিন থেকে লাঠিকে অবজ্ঞা করে বাঙালি বোমা বন্দুক ধরেছে সেদিন থেকেই বাঙালির অধঃপতন শুরু হয়েছে। ভেবে দেখুন সাপ মারতে, বেড়াল তাড়াতে, চোরকে ভয় দেখাতে লাঠি চিরকাল কী উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে এসেছে। এই লাঠি ল্যাংড়া মানুষের ঠ্যাঙের ভূমিকা নেয়, বুড়ো মানুষদের কমজোরি হাঁটুকে সাহায্য করে, লাঠিধারী সেপাইকে আজও মানুষ সমীহ করে। লাঠির সনাতন ঐতিহ্যকে যে আবার ফিরিয়ে আনা দরকার তা নবীনের এই আশ্চর্য লাঠিই প্রমাণ করেছে। ভাইসব, আমি স্থির করেছি আগামী নির্বাচনে আমাদের দলের নির্বাচনী প্রতীক হবে লাঠি। জানি না নির্বাচন কমিশনে লাঠি প্রতীক চিহ্ন আছে কি না, তবে আমার রচনা প্রবেশিকা বইয়ে এবার লাঠি নিয়ে একটা জ্বালাময়ী রচনা আমি ঢুকিয়ে দেব। আপনাদের কাছে নতুন করে রচনা প্রবেশিকার কথা বলার দরকার নেই। আপনারা সকলেই জানেন, রচনা প্রবেশিকা পড়ে ছাত্ররা রচনায় কুড়ির মধ্যে আঠারো-উনিশ নম্বর পর্যন্ত পেয়ে থাকে। গরিব ছাত্রদের কথা ভেবে আমরা রচনা প্রবেশিকার মূল্য এবার আরও কমিয়ে বত্রিশ টাকা করেছি। ভেবে দেখুন, বর্ধিত কলেবরের এই বইটি আরও সুলভে পাওয়ায় কত লাভ হচ্ছে আপনাদের। তাই বন্ধুগণ…”
লোকটা আরও যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সভায় একটা শোরগোল ওঠায় চুপ মেরে গেল।
ভিড়টা একটু পাতলা না হলে লাঠিটা সরানোর ফাঁক পাওয়া যাবে । নিমাই তাই ঘাঁতঘোঁত দেখে রাখার জন্য পা বাড়াল।
কিন্তু আবার বাধা পড়ল, পিঠে একটা শক্ত জিনিসের শক্ত খোঁচার সঙ্গে একটা পিলে-চমকানো গলা, “হ্যান্ডস আপ! হাত তোলো৷”।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিমাই বলল, “আজ আমার পিঠের উপর বড় ধকল যাচ্ছে যে দারোগাবাবু!”
একটা ব্যঙ্গের হাসি হেসে গগনদারোগা বলে, “তা হলে তোর পিঠটা একটা পীঠস্থান হয়ে উঠল নাকি রে নিমাই?”
“সে আর কবেন না। তা আপনি ভাল আছেন তো! পেন্নাম হই।”
“বাঃ বাঃ! সহবত তো বেশ ভাল রপ্ত করেছিস দেখছি!”
“আপনাকে ভক্তিছেদ্দা জানাব না তো কাকে জানাব বলুন! আপনি হলেন তল্লাটের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, গুরুজন, পিতৃতুল্য। দেখলেই মাথা আপনা থেকেই হেঁট হয়ে আসে।”
“বাঃ বাঃ! আর-একটু বল তো শুনি!”
“পিস্তলটা খাপে ভরে ফেলুন দারোগাবাবু। আমাদের মতো মনিষিদের জন্য আর পিস্তলকে লজ্জা দেওয়া কেন? অন্তরটার তো একটা মানসম্মান আছে?”
টেকো এবং গোলগাল চেহারার গগনদারোগা পিস্তলটা খাপে ভরে বলে, “এবার বল তো, বটতলার অন্ধকারে বসে কার সঙ্গে শলাপরামর্শ করলি এতক্ষণ!”
নিমাই হেসে একেবারে কুটিপাটি হয়ে বলে, “শলাপরামর্শ! কী যে বলেন দারোগাবাবু, শলাই বা কীসের আর পরামর্শই বা কাকে দেব! আমাকে কথা কইতে শুনেছেন বুঝি! ওই একটা রোগ হয়েছে আমার এই বুড়ো বয়সে। একা-একাই কথা কই। আমার বউও প্রায়ই বলে, ওগো, তুমি যে একা-একা কথা কও, এ তো ভাল লক্ষণ নয়! মাথার দোষ না হয়ে যায়!..”
গগন অবাক হয়ে বলে, “বউ! তোর আবার বউ কোথায়? তুই তো বিয়েই করিসনি!”