খুব চিন্তিত মুখ করে নিমাই বলে, “আজ্ঞে, তাও তো বটে! কথাটা ভেবে দেখার মতোই মনে হচ্ছে।”
পানুবাবু ফের একটা রামখোঁচা দেওয়ার জন্য ছড়িখানা তুলতেই নিমাই এক লাফে খানিক পিছিয়ে এসে একগাল হেসে বলল, “কোনওদিন কি আপনার আদেশ অমান্য করেছি পানুবাবু? জলে বাস করে কি কুমিরের সঙ্গে বিসংবাদ চলে? তা ছাড়া আমি ঝামেলা ঝাট, রক্তারক্তির মধ্যে নেইও।”
“আজ রাতেই মালটা সাফ করা চাই।”
ঘাড় চুলকে ভারী লাজুক গলায় নিমাই বলে, “যে আজ্ঞে, তা কীরকম কমিশন দেবেন পানুবাবু?”
“কমিশন ভালই পাবি রে, খুব ভাল। দুনিয়ায় সবচেয়ে দামি জিনিস কী জানিস?”
গদগদ হয়ে নিমাই বলে, “তা আর জানি না! হিরে বলুন, জহরত বলুন, সোনাদানা বলুন, তারপর শাল দোশাল বলুন, কস্তাপেড়ে শাড়ি কি ফরাসডাঙার ধুতি বলুন, তারপর গলদাচিংড়ি কি পাঁঠার মাংস বলুন কোনটা দামি নয়? এমনকী মুড়ির দামও তো ঠেলে উঠছে!”
পানুবাবু মিটিমিটি হেসে বললেন, “তার চেয়েও ঢের দামি জিনিস আছে রে। গোটা একটা রাজ্য দিলেও তার দাম হয় না, সেটা হল মানুষের প্রাণ। তোকে যে প্রাণে মারব না সেটা কি কম বকশিশ হল নাকি রে বেল্লিক?”
ভারী আপ্যায়িত হয়ে নিমাই বলল, “তা বটে, প্রাণের চেয়ে দামি আর কী-ই বা আছে! তবে কিনা ওই সঙ্গে ফাউ হিসেবেও যদি কিছু পাওয়া যেত!”
“সে আমি ভেবে রেখেছি। জিনিসটা উদ্ধার করতে পারলে তোকে আমার দলে নিয়ে নেব। আমার হয়ে গঞ্জের বাজারে আর হাটবারে তোলা আদায় করবি। কুড়ি পারসেন্ট বাঁধা কমিশন। দু’দিনেই লাল হয়ে যাবি।”
নিমাই মনে মনে ঠিক করে ফেলল, লাঠিটা হাতে আসার পর এই পানুবাবুকে দিয়ে সে দু’বেলা এঁটো বাসন মাজাবে আর ঘরদোর ঝটপাট দেওয়াবে। মাথা ঝাঁকিয়ে হাতজোড় করে সে বলল, “আজ্ঞে, এ তো হাতে চাঁদ পাওয়ার শামিল। কতকাল ধরে ইচ্ছে, আপনার সেবায় একটু লাগি। তা হলে আজ বিদেয় হই পানুবাবু!”
“মনে থাকে যেন!” হাতে এখন অনেক কাজ। মাথা খাটানো, ফন্দিফিকির বের করা, কার্যোদ্ধার করা। সুতরাং নিরিবিলিতে বসে একটু ভাবা দরকার।
রাস্তার ওপাশে একটা ঝুপসি বটগাছ। তলায় জম্পেশ অন্ধকার। নিমাই গুটিগুটি গিয়ে অন্ধকারে সেঁধিয়ে জুত করে বসে পড়ল। তিন চারটে ফিকির আছে হাতে। কোনটা কাজে লাগানো যায় সেইটেই ভেবে ঠিক করতে হবে।
আচমকাই পিঠে গদাম করে কী একটা ভারী জিনিস এসে পড়তেই বাপ রে’ বলে উপুড় হয়ে পড়ল নিমাই। সামলে ওঠার আগেই একটা ভারী গলা চাপা স্বরে বলল, “ওই পানু ব্যাটা কত দর দিল রে?”
নিমাই ধীরে ধীরে উঠে বসল। পিছনে মস্ত একখানা পেতলে বাঁধানোমোটা ভারী লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে হিরু গায়েন। চারটে খুন, গোটা ছয়েক ডাকাতির মামলায় তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ। এই হিরু গায়েনের জন্যই হয়রান হয়ে-হয়ে গগনদারোগার ওজন বারো কেজি কমে গেছে, রাতে ঘুম নেই, খাওয়ায় অরুচি, গোবিন্দচরণ দাস বাবাজির কাছে বোষ্টম মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে ফোঁটা-তিলক কষ্ঠী ধারণ করেছে, তবু শান্তি পায়নি।
নিমাইয়ের বুকের ভিতরটা গুড়গুড় করতে লেগেছে। তবে সেটা চেপে রেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “হিরুদাদা না? আহা, চেহারাটা যে একেবারে আদ্দেক হয়ে গেছে! তা শরীর-গতিক সব ভাল তো! আমরা তো ভেবে ভেবেই মরি, আমাদের আদরের হিরুদাদার হলটা কী? দেখা-সাক্ষাৎ পাই না মোটে!”
চার হাত লম্বা, দুই হাত চওড়া, পাথরে কোঁদা দানবের মতো চেহারার হিরু গায়েন দু’খানা জ্বলজ্বলে চোখে তাকে ফুটো করে দিয়ে বলল, “লাঠির জন্য পানু কত দর দিল?”
মলিন মুখে মাথা নেড়ে নিমাই বলল, “পানুবাবুর হাত মোটেই দরাজ নয়। মুঠো আলগা করতেই চান না। সামান্য দু’লাখ টাকা দিতে চেয়েছেন। আমি চাপাচাপি করায় টেনেমেনে আড়াই লাখে উঠেছেন। আমি তবু গাঁইগুঁই করায় বলেছেন, আরও কিছু দেবেন।”
হিরু তার নাগরা-পরা ডান পা-টা তুলে নিমাইয়ের কাঁকালে ছোট্ট একটা লাথি কষিয়ে বলল, “লাখ টাকা কখনও চোখে দেখেছিস? দিলে গুনে উঠতে পারবি?”
নিমাই কোঁক শব্দ করে ছিটকে গিয়েছিল। মাজা চেপে ধরে উঠে বসে হাসি-হাসি মুখ করে বলল, “সেটাই তো সমস্যা। না হিরুদাদা, লাখ টাকা গুনতে গেলে নির্ঘাত মাথা গুলিয়ে যাবে। আমিও সেই কথাই বলছিলুম পানুবাবুকে, অত টাকার দরকার কী? দু-পাঁচ টাকা কম হলেও হয়। আর তেমন-তেমন লোক হলে আরও দশ-বিশ হাজার কমেই করে দেব না হয়! এই আপনিই যদি ভালবেসে বলেন, ‘ওরে নিমাই, লাঠিটা এনে দে, তা হলে কি আমি দর কষতে বসব? আপনজনদের সঙ্গে কি দরকষাকষি চলে?”
হিরু গম্ভীর মুখে বলল, “না, চলে না। দর কষলে তোর মতো আপনজনদের জন্য আমার অন্য ব্যবস্থা আছে। মাজারের পিছনে মজা পুকুরটা চিনিস? সেখানে জল নেই, দশ হাত গভীর থকথকে কাদা। তোকে যদি হেঁটমুন্ডু করে মজা পুকুরে ফেলে দিই, একশো বছরে তোর লাশ কেউ খুঁজে পাবে না তা জানিস?”
ফ্যালফ্যালে হাসি হেসে নিমাই মাখো-মাখো গলায় বলে, “আরে না, না, ছিঃ ছিঃ, এত মেহনত করতে যাবেন কেন? ধকলটাও তত কম যাবে না। নিজের শরীর-গতিকের কথাও তো মনে রাখতে হবে! আপনার দায়িত্ব কি কম? বিশ-পঁচিশটা গাঁয়ের প্রজাপালন আছে, ন্যায়বিচার আছে, এর-ওর-তার তবিল ফাঁক করা আছে, কী খাটুনিটাই যায় আপনার!”