লোকটা উত্তেজিত হয়ে বলল, “তুমি তো আচ্ছা আহাম্মক! বাপু হে, শ্বশুরবাড়ি ছাড়া আমাদের মতো মনিষ্যির কোথাও কোনও দাম আছে? আর সব জায়গায় ঘাড়ধাক্কা খেলেও শ্বশুরবাড়িতে আমরা রাজাগজা। এই তো গেল হপ্তায় রাত বারোটায় শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছিলুম। শাশুড়িঠাকরুন গায়ে একশো পাঁচ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে উঠেও পোলোয়া রান্না করে খাওয়ালেন। বোকার মতো বসে থেকো তো! ওঠো, ওঠো, বুক চিতিয়ে বীরের মতো ভিতর বাড়িতে ঢুকে যাও…”
আশপাশের লোক কথাবার্তা শুনে তাকাচ্ছে দেখে নিমাই প্রমাদ গুনে উঠে পড়ল। কাচুমাচু হয়ে বলল, “যাচ্ছি মশাই, যাচ্ছি। এই রাতে গুরুপাক খাওয়াটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না।”
লোকটা খিঁচিয়ে উঠে বলল, “গুরুপাক! গুরুপাক আবার কী? পেট ঠেসে খাওয়ার পর হরিপুরের একঘটি জল খেয়ে নেবে। পাথর অবধি হজম। বলো তো আমিই তোমাকে সঙ্গে করে অন্দরমহলে পৌঁছে দিয়ে আসছি!”
নিমাই আঁতকে উঠে বলল, “না না, তার দরকার নেই। এ বাড়ির অন্ধিসন্ধি আমার জানা। ছেলেবেলা থেকেই যাতায়াত কিনা!”
“কীরকম, ছেলেবেলা থেকেই যাতায়াত কীরকম? তোমাদের কি বাল্যবিবাহ হয়েছিল নাকি?”
ফাঁপরে পড়ে নিমাই তাড়াতাড়ি বলল, “অনেকটা ওরকমই বটে। আচ্ছা মশাই, আসি গিয়ে তবে!”
বাইরের রাস্তায় এসে নিমাই একটু দাঁড়ায়। কাজটা যে খুব সহজ হবে না তা সে বুঝতে পারছে, একটা বিড়ি ধরাবে কি না ভাবতে ভাবতে সর্বে পকেটে হাত ভরেছে অমনই পিঠে একটা শক্ত খোঁচা খেয়ে বাপ রে’ বলে ঘুরে তাকায় নিমাই। যা দেখল তাতে রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার কথা। সামনে দাঁড়িয়ে পানুবাবু। হাতে রুপো বাঁধানো ছড়ি।
পানুবাবুর পরনে কোঁচানো ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি, চুলে টেরি, গায়ে দামি শাল, গলায় কম্ফটার। এখন শীতকাল বলে হাঁটু অবধি মোজা আর পাম্পশু। ডান আর বাঁ হাতে গোটা কয়েক হিরে, চুনি, পান্নার আংটি ঝকমক করছে।
পানুবাবু ভারী মোলায়েম গলায় বললেন, “সুবিধে হল না বুঝি?”
তটস্থ হয়ে নিমাই হাতজোড় করে বলে, “পানুবাবু যে! পেন্নাম হই! কীসের সুবিধের কথা বলছেন আজ্ঞে? এ জন্মে আর সুবিধে হল কোথায় বলুন। সব তাতেই কেবল অসুবিধে, সুবিধের মুখ আর ইহজন্মে দেখা হল না। তা আপনি এখানে? ইদিকে কাজ ছিল বুঝি?”
পানুবাবু জরদা-পানের পিক ফেলে বললেন, “তা কাজ আছে বই কী। কিন্তু তার আগে জানা দরকার তুই এখানে কী মতলবে ঘুরঘুর করছিস!”
নিমাই মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে, মতলব কিছু নেই। ওই লাঠি নিয়ে কী সব গালগল্প কানে এল, তাই ভাবলুম যাই, গিয়ে একটু দেখে আসি৷”
ভারী মোলায়েম আর মিঠে গলায় পানুবাবু বললেন, “কিন্তু আমার কাছে যে অন্য রকম খবর আছে রে নিমাই! ঘণ্টাতিনেক আগে যে তোকে ওই লাঠিখানা কাঁধে নিয়ে নবীনের সঙ্গে ভুরফুনের মাঠে দেখা গেছে!”
নিমাই সিঁটিয়ে গিয়েও ভারী অবাক হওয়ার ভাব করে বলল, “আমাকে দেখা গেছে! ভারী আশ্চয্যি ব্যাপার তো! কিন্তু আমারই
তো চোখে পড়েনি! ভুল খবর নয় তো পানুবাবু!”
মিষ্টি হেসে পানুবাবু বললেন, “না হে নিমাই, খবর বড় পাকা।”
“তা আপনি যখন বলছেন তখন বোধ হয় তাই হবে।”
ছড়িটা তুলে আচমকা তার পেটে একটা রামখোঁচা দিয়ে পানুবাবু বললেন, “আসল কথাটা কি এবার পেট থেকে বের করবি?”
আঁক করে দু’হাতে পেটটা চেপে ধরে নিমাই বলল, “আজ্ঞে, বলছি, বলছি! ওই নবীন ছোঁকরার সঙ্গে আজই গঞ্জে আলাপ হল কিনা! হাতে লাঠি দেখে দু-চারটে কথা কইলুম। আমি সনাতন ওস্তাদের চেলা শুনে ছোঁকরা আমার কাছে তালিম নিতে চাইল।”
পানুবাবু হোহো করে হেসে বললেন, “বটে! তুই সনাতন ওস্তাদের কাছে লাঠি শিখেছিস বুঝি! কিন্তু আমার কাছে যে অন্যরকম খবর আছে রে নিমাই! তুই সনাতনের কাছে নাড়া বেঁধেছিলি বটে, কিন্তু মাসখানেক বাদেই তার ঘটিবাটি চুরি করে পালাস। তুই তো ছিচকে চোর, লেঠেল হলি কবে?”
নিমাই কোণঠাসা হয়ে ভারী বিনয়ের সঙ্গে বলল, “আজ্ঞে, ইচ্ছে তো ছিল খুব। বড় লেঠেল হব, তা পেটের দায়ে হয়ে উঠল না আজ্ঞে।”
“দ্যাখ, মিথ্যে কথা বলাটাও একটা আর্ট। বাল্মীকি, বেদব্যাস থেকে রবি ঠাকুর অবধি কে না সাজিয়ে-গুছিয়ে মিথ্যে কথা লিখে গেছে! কিন্তু সেসব লোকে মাথায় ঠেকিয়ে পড়ে। আর তুই দাঁত কেলিয়ে যেগুলো বলিস, সেগুলো ছুঁলে চান করতে হয়। বুঝলি!”
ঘাড় হেলিয়ে নিমাই বলল, “যে আজ্ঞে।”
“তবে তোকে আমার দরকার। একজন পাকা চোর না হলে কাজটা উদ্ধার হবে না। ওই লাঠিখানা আমার চাই।”
ভারী ভালমানুষের মতো চোখ বড় বড় করে চেয়ে নিমাই বলে, “সেকী পানুবাবু, সামান্য একখানা বাঁশের লাঠির জন্য আপনিও উতলা হলেন? ওসব গপ্পো বিশ্বাস করেন নাকি?”
পানুবাবু ঠান্ডা চোখে চেয়ে বললেন, “তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুইও করিস! করিস না?”
ঘাড়টাড় চুলকে নিমাই বলে, “কী যে বলেন পানুবাবু!”
“দ্যাখ, বোকা আর আহাম্মকেরা ভাবে আমার বুঝি দুটো মাত্র চোখ। বাইরে থেকে দেখলে চোখ আমার দুটোই বটে, কিন্তু যারা জানে তারা জানে যে, আমার হাজারটা চোখ চারদিকে ঘুরছে।”
সঙ্গে সঙ্গে একমত হয়ে নিমাই বলল, “তা বটে।”
“লাঠির গপ্পো যদি সত্যিই না হবে তা হলে পুরনো কেল্লায় যে গ্যানার দলের ষণ্ডা-গুন্ডারা হাতে-পায়ে-মাথায় কাঁকালে লাঠির চোট নিয়ে সব কেঁদেককিয়ে-ঘেঙিয়ে একশা হচ্ছে, তাদের ও দশা করল কে? তোর আর নবীনের মতো দুটো আনাড়ি?”