ভিড় থেকে একজন বলল, “মনুমেন্ট!”
আর-একজন চেঁচাল, “কাশীর প্যাঁড়া।”
পরমেশ্বর মাথা নেড়ে বলল, “আরে না, না। হ্যাঁ মনে পড়েছে! ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যান, টেমস নদীর সুড়ঙ্গ। আর অষ্টম আশ্চর্য আজ দেখলাম, এই লাঠিখানা। এই লাঠিখানা আজ আমার ভাইপো নবীনকে প্রাণে বাঁচিয়েছে, একদল বদমাশকে পিটিয়ে ঠান্ডা করেছে। এ বড় সোজা লাঠি নয়।”
বিশ্ববোকা হরেন গনাই বলে উঠল, “আহা, লাঠিখানা তো মোটেই বাঁকা নয় হে। দিব্যি সোজা, সটান লাঠি!”
পরমেশ্বর মাথা নেড়ে বলল, “দেখতে সোজা হলে কী হয়, এর মধ্যে স্বয়ং শিব ঢুকে বসে আছেন যে!”
কালীভক্ত চরণ দাস গম্ভীর গলায় বলে, “শিবের হাতে আবার লাঠি কবে দেখলে হে পরমেশ্বর? শিবের হল শূল। তার তিন ফলা।”
বাধা পেয়ে পরমেশ্বর বিরক্ত হয়ে বলল, “আরে শূলটা তো লাঠির মাথাতেই বসানো! ওটা খুলে নিলেই শূল লাঠি হয়ে গেল!”
শ্রীপদ মল্লিক বলে উঠল, “গোঁজামিল দিলেই তো হবে না মশাই, শূল হল শূল, আর লাঠি হল লাঠি। বগি থেকে ইঞ্জিন খুলে নিলেই কি আর রেলগাড়িকে গোরুর গাড়ি বানানো যায়?”
গদাইনস্কর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “দেবতাদের অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে কিন্তু লাঠিকে ধরা হয় না।”
সবজান্তা সনাতন দাস হেঁকে বলল, “কে বলে ধরা হয় না? স্বয়ং গাঁধীজির হাতে লাঠি ছিল না? ওই লাঠি দিয়ে পেঁদিয়েই তো সাহেবদের বৃন্দাবন দেখালেন!”
গোপাল বৈরাগী ফস করে বলে উঠল, “গাঁধীজিকে মোটেই দেবদেবীদের খাতে ধরা হয় না।”
সনাতন ফুঁসে উঠে বলল, “কে বলল কথাটা? মুখোনা একটু দেখি চাঁদুর! ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফসিলের চুয়ান্ন নম্বর ধারাটা দেখে নিয়ো। গাঁধীজিকে ভগবানের ক্লাসে প্রমোশন দেওয়া হয়ে গেছে।”
গোপাল বৈরাগী থতমত খেয়ে মুখ লুকিয়ে ফেলল।
নাস্তিক নবকিশোর বলে উঠল, “অনেকক্ষণ ধরে তো লাঠির মহিমা শোনাচ্ছেন মশাই! এই সায়েন্সের যুগে কেউ মিরাকল বিশ্বাস করে নাকি? মিরাকল-টিরাকল সব মিথ্যে, জ্যোতিষশাস্ত্র একটা বুজরুকি, ভগবান নেই, ভূত নেই! আমাদের বিজ্ঞান যুক্তি সমিতি, সংক্ষেপে ‘বিযুস’ ঘোষণা করেছে, মিরাকল বা অলৌকিক কিছু প্রমাণ করতে পারলে তাকে হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। এখন দেখান তো লাঠির কেরানি!”
বুড়ো পঞ্চানন মণ্ডল মুখের হকিটা এক গাল থেকে অন্য গালে নিয়ে বলল, “ওহে বাপু পরমেশ্বর, এবার জবাব দাও। বাক্য হরে গেল যে! সেই কখন থেকে লাঠির মহিমা দেখার জন্য এসে বসে আছি! তা কোথায় কী? কেবল বক্তিমে হচ্ছে। ওদিকে খিচুড়ি ঠান্ডা হয়ে গেল, হাঁটুতে বাতের ব্যথা চিরিক দিচ্ছে, মাথায় হিম পড়ছে, যত্ত সব…”
তান্ত্রিক জটাধর লাফিয়ে উঠে হুংকার দিয়ে বলে উঠল, “ওরে পাষণ্ড নবা, তোর শিরে যে বজ্রাঘাত হবে! বজ্রাঘাত না হলেও সর্পাঘাত তো নির্ঘাত। পারবি গাজির মোড়ের বটগাছতলায় রাত বারোটায় নিজের নাম সই করা একখানা কাগজ পাথর চাপা দিয়ে রেখে আসতে? তবে বুঝব তুই বাপের ব্যাটা! বুক ঠুকে বল তো সবার সামনে পারবি কিনা! পারলে তোকেই আমি হাজার টাকা দেব।”
নবা, অর্থাৎ নবকিশোর ভিড়ের মধ্যে একটু পিছিয়ে গেল। ভিড়ের পিছন দিকটায়, মস্ত একটা শিউলি গাছের ঝুপসি ছায়ায়, মাথা-মুখ র্যাপারে ঢেকে বসে ছিল নিমাই। চোখ চারদিকে ঘুরছে। শুভ কাজের আগে চারদিকটা ভাল করে জরিপ করে নিতে হয়। কোথা থেকে বিপদ আসতে পারে তা আঁচ করতে হয়, পালানোর পথের হদিশ রাখতে হয়, একই মতলবে অন্য কেউ ঘুরঘুর করছে। কিনা সেটাও দেখা দরকার। আটঘাট না বেঁধে হুড়ুম করে কাজে নেমে পড়াটা বুদ্ধিমানের লক্ষণ নয়। ওদিকে মাথার উপর খাঁড়া ঝুলছে, সকালে লাঠি নিয়ে কেল্লায় হাজির হতে না পারলে তার বাড়িতে গ্যানা আগুন দেবে। তবে কিনা গ্যানার গায়ের জোর থাকলেও বুদ্ধিটা বড়ই রোগাভোগা। ওই জাদুই লাঠি হাতে এলে নিমাই দরবারে হাজির হবে বটে, তবে অন্য চেহারায়। সব আগেভাগে ভেবে রেখেছে সে। লাঠি উদ্ধার হলে আরও কত কী যে করা যাবে তার লেখাজোখা নেই। ওর জোরে গোটা পরগনাই তার ট্যাঁকে এসে গেল আর কী। মুরুব্বি মাতব্বরেরা দোবেলা সেলাম দেবে। সেলামিও আসবে হাসতে হাসতে। টাকা গোনার জন্য তোক রাখতে হবে। গগনদারোগা একবার তাকে সাতপুরার বিরু মণ্ডলের গোরু চুরির জন্য সাত হাত নাকখত দিইয়েছিল। রাগটা পুষে রেখেছে সে। এবার গগনদারোগা এসে রোজ সন্ধেবেলা তার পা টিপে দেবে। এই সব ভেবে-ভেবে আপনা থেকেই তার ঠোঁটে একটু আহ্লাদের হাসি ফুটে উঠছিল মাঝে মাঝে।
আচমকা কোমরে একটা কনুইয়ের খোঁচা খেয়ে আঁতকে উঠল নিমাই। চেয়ে দ্যাখে, যে লোকটা রাস্তা থেকে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এল সেই লোকটা। বড় বড় চোখে ভারী অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে লোকটা বলল, “তুমি এখানে বসে আছ যে বড়? তুমি না নবীনের ভগ্নীপোত! বাড়ির জামাই! মস্ত কুটুম! তোমার ঠাই কি এখানে হে! যাও, ভিতর বাড়িতে যাও! বাড়ির কেউ দেখে ফেললে যে বড্ড লজ্জার ব্যাপার হবে হে!”
নিমাই অপ্রস্তুত হয়ে সেঁতো হাসি হেসে বলল, “ভিতর বাড়িতে গেলে শাশুড়িঠাকরুন বড় আতান্তরে পড়ে যাবেন যে! কানাঘুষো শুনলুম, আজ নাকি বাড়িতে চুনো মাছ রান্না হয়েছে। জামাইকে তো আর চুনো মাছ দিয়ে ভাত বেড়ে দেওয়া যায় না! শীতের রাতে হয়তো আবার পুকুরে জাল ফেলতে হবে! তারপর ধরুন, মাছের আগেও তো কিছু দিতে হয় পাতে। সোনামুগের ডাল, কি পোরের ভাজা, কি পোস্তচচ্চড়ি, কি মুড়িঘণ্ট। শেষ পাতে একটু পায়েসটায়েস। না, না, এত রাতে ভিতরে গিয়ে তাদের বিব্রত করা ঠিক হবে না।”