ন’টায় হরিপুরে নিশুতি রাত। এবার শীতটাও খুব জেকে পড়েছে। তার উপর এই সময়ে আশপাশে চিতাবাঘের উপদ্রব হয় খুব। কাজেই সন্ধের পরেই যে-যার ঘরে ঢুকে যায়। শুধু বাজারের দিকটায় কিছু লোক চলাচল আছে, তবে তাদের সংখ্যা হাতে গোনা যায়, দু-চারজন সবজি আর মাছের ব্যাপারী এখনও আশায়-আশায় টেমি জ্বেলে বসে আছে। গোটাকয়েক দোকানি এখনও ঝাঁপ ফেলেনি। হালুইকর পীতাম্বর এখন বসে বসে ছাঁচে ফেলে বাতাসার সাইজের সন্দেশ তৈরি করে যাচ্ছে। দরজি ননীগোপাল সেলাই মেশিনে কার যেন লেপের ওয়াড় বানাচ্ছে। ডাক্তার গিরিধারী দাস তার চেম্বারে নব্বই বছর বয়সি খগেন মণ্ডলের নাড়ি টিপে চোখ বুজে বসে আছে। আর সব শুনশান।
নিমাই চাঁদরে মাথা-মুখ ঢেকে নিয়ে সন্তর্পণে বাজারের এলাকাটা পার হল। রাতবিরেতে উটকো লোকের গাঁয়ে আনাগোনা লোকে পছন্দ করে না। হরিপুর নিমাইয়ের চেনা জায়গা নয়, জানাশোনাও নেই কারও সঙ্গে। সুতরাং সাবধান না হলে বিপদ।
পিছন থেকে কে যেন হাঁক মারল, “কে রে? শ্যামাপদ নাকি?”
না, সে শ্যামাপদ নয়। তবু নিমাই দাঁড়িয়ে পড়ল। অচেনা জায়গায় মাথা ঠান্ডা রাখা ভাল। দৌড়ে পালালেই বিপদ। লোকটা কাছে আসতেই সে বিনয়ের সঙ্গে বলল, “না, আমি শ্যামাপদ নই। আমি হলুম নবীনের দূর সম্পর্কের ভগ্নিপোত।”
লোকটা খুশি হয়ে বলল, “ও, ওই লাঠিটার জন্য এসেছ বুঝি? তা ভাল। আজ সবাই তো ওখানে গিয়েই জুটেছে। আমি যদিও বুজরুকিতে বিশ্বাস করি না, তবু কাণ্ডটা কী তা দেখতেই যাচ্ছি। চলো, চলো!”
নিমাই প্রমাদ গুনল। সর্বনাশ! লাঠির কথা ইতিমধ্যেই তা হলে চাউর হয়ে গেছে! তবে ভিড়ের যেমন অসুবিধে আছে, তেমনই আবার সুবিধেও আছে। সে ভাবতে ভাবতে লোকটার পাশে পাশে হাঁটতে লাগল।
৪. পাঁচটা সূর্যমুখী লঙ্কা
পাঁচটা সূর্যমুখী লঙ্কা আর পনেরোখানা বেগুনি দিয়ে ছোট একধামা মুড়ি শেষ করে জল খেয়ে জগাই বলল, “বুঝলে মাধাইদা, এইবার খিদেটা হতে লেগেছে। মুড়িটা পেটে গিয়ে খিদের বীজতলাটা তৈরি হয়ে গেল।”
মাধাই মুড়ির শূন্য ধামাটা সরিয়ে রেখে আধঘটি জল গলায় ঢেলে বলল, “তুই কি জানিস যে, হরিপুর জায়গা খুব খারাপ?”
“কেন গো মাধাইদা, হরিপুরের তো তেমন কোনও বদনাম নেই!”
“সে না থাকলেও এ জায়গা ভাল নয়। এখানকার জল পেটে গেলেই যা খেয়েছিস সব কয়েক মিনিটেই হজম হয়ে যায়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফের খিদে চাগাড় দেয়।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। হরিপুরের জলের কথা খুব শুনেছি। সবাই সুখ্যাতি করে। তাতে খারাপটা কী দেখলে?”
মাধাই বড় বড় চোখে চেয়ে বলল, “খারাপ নয়? আমাদের মতো গরিবগুরবোদের ঘণ্টায় ঘণ্টায় খিদে পেলে রোজগারের পয়সা যে শুধু পেটপুজোয় খরচ হয়ে যাবে! সেটা কি ভাল? এ জায়গায় থাকলে আমাদের পোষাবে না রে জগাই।”
জগাই একটু চুপ করে থেকে বলল, “এটা একটা ভাববার মতো কথা বটে! পনেরোখানা বেগুনি আর একধামা মুড়ি তো কম নয়। কিন্তু যেই হরিপুরের জল পেটে গেছে অমনই সব যেন কোথায় তলিয়ে গেল! নাঃ মাধাইদা, লক্ষণ মোটেই ভাল নয়।”
“সেই কথাই তো বলছি। এই তো এই বাড়ির গিন্নিমা ডেকে বললেন, রাত্তিরে যেন ডাল দিয়ে বেশি ভাত খেয়ে না ফেলি। আজ নাকি লম্বা খাওয়া আছে। ডাল, ভাজা আর লাবড়ার তরকারি দিয়ে শুরু। তারপর দুই পদ মাছ আর চাটনি হয়ে নলেন গুড়ের পায়েস অবধি। শুনে ভারী আনন্দও হল। জন্মে তো আর ওসব তেমন খাওয়া হয়নি। আমাদের লঙ্কা আর নুন হলেই একথালা ভাত উঠে যায়। কিন্তু ভয় কী জানিস? পেট ঠেসে খাওয়ার পর যে-ই জলটি খাব অমনই পেটটা ফঁকা-ফঁকা লাগতে থাকবে। মনে হবে, সত্যিই কি কিছু খেয়েছি? নাকি স্বপন দেখছিলুম! তারপর ধর, এই অবস্থায় শিয়রে চিড়ে-মুড়ি কিছু না নিয়ে শুলে মাঝরাত্তিরে যখন পেট চুই চুই শুরু করবে, তখন কী উপায়?”
জগাই ভাবিত হয়ে বলল, “সত্যিই তো! এ তো বড় বিপদের কথা হল! আমাদের গঞ্জের জল যেন পাথর, পেটে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। নড়বার নামটি নেই। যা খাও তা পেটে গিয়ে আড়মোড়া ভাঙে, হাই তোলে, গড়িমসি করতে থাকে, খানিক জিরোয়, একটু ঘুমিয়েও নেয়। তারপর ধীরেসুস্থে সময়মতো নেমে যায়। কিন্তু এখানে তো খাবার দাবার পেটে গিয়ে মোটে বসবার সময় পায় না। হরিপুরের জল গিয়ে তাদের অ্যায়সা তাড়া লাগায় আর এমন হুড়ো দেয় যে, বেচারারা পালাবার পথ পায় না। বেচারাদের দম ফেলার ফুরসতই হচ্ছে না। এই যে মুড়ি-বেগুনি সাঁটলুম, কোথায় গেল বলো তো? পেট তো বেশ খাঁখাঁ করছে। নাঃ মাধাইদা, তুমি ঠিকই বলেছ। হরিপুরে আমাদের পোষাবে না।”
মাধব একটা হাই তুলে বলে, “নবীন অবশ্য বলছিল হরিপুরেই আমাদের একখানা দোকান করে দেবে। বিক্রিবাটা নাকি ভালই। সেটাও একটা ভাববার মতো কথা।”
“হুঁ। প্রস্তাবটা ফ্যালনা নয়। ভাবনাটাবনা তোমার বেশ ভাল আসে। ও তুমিই বসে ভাবো। আমি কিছু ভাবতে গেলেই মাথাটা বড্ড ঝিমঝিম করে।”
ওদিকে নবীনদের উঠোনে গাঁ ঝেটিয়ে লোক এসে জুটেছে। গাঁয়ে আজ যাত্রা হওয়ার কথা ছিল, সেখানে লোকাভাবে আসর ভেঙে গেছে। দাওয়ার উপর জলচৌকিতে নতুন গামছা পেতে লাঠিটা শোয়ানো হয়েছে। নবীনের জ্যাঠা পরমেশ্বর গাঁয়ের স্কুলের হেডমাস্টার এবং পঞ্চায়েতের চাই। বলিয়ে কইয়ে মানুষ। পরমেশ্বর দাঁড়িয়ে একখানা ভাষণ শুরু করল, “বন্ধুগণ, আজ আমরা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের সম্মুখীন। সপ্তম আশ্চর্য পর্যন্ত এতকাল আমাদের জানা ছিল। আগ্রার তাজমহল, চিনের প্রাচীর, মস্কোর ঘণ্টা, মিশরের পিরামিড, আর কী যেন…”