নিমাই ঠান্ডা গলায় বলল, “না হচ্ছে না। তার কারণ, নবীন কস্মিনকালেও লেঠেল নয়। ও লাঠি ভাল করে ধরতেও জানে না।”
“বাঃ বাঃ! তা হলে আনাড়ির কাছে মার খেয়ে এলি বল! তা হলে
তো তোর আরও লজ্জা হওয়া উচিত। বাদুড়ের মতো হেঁটমুন্ডু হয়ে ঝুলে থাক। ওরে কালু, কড়িবরগা থেকে একটা দড়ি ঝুলিয়ে এটাকে হেঁটমুন্ডু করে রেখে দে তো!”
নিমাই একটু ঠোঁট চেটে নিয়ে বলল, “সর্দার, ভাল করে শোনো। মাথা ঠান্ডা রাখো। আমরা মোটেই নবীনের হাতে মার খাইনি। আমার কথায় যদি বিশ্বাস না হয়, কাল সকালে হরিপুরে তোক পাঠিয়ে খবর নিলেই জানতে পারবে, নবীন জীবনে লাঠিখেলা শেখেনি।”
“তা হলে লাঠিটা খেলল কে? ভূতে?”
“সেই কথাটাই বলতে চাইছি। কাণ্ডটা ভূতুড়েই বটে। লাঠিটা গঞ্জ থেকেই আমার হাতে ছিল। কাঁধে ফেলে নিয়ে আসছিলাম। মাঝ রাস্তায় হঠাৎ শুনি, লাঠিটার ভিতর থেকে মন্ত্র পড়ার শব্দ আসছে। প্রথমটায় বুঝতে পারিনি। একটু বাদেই টের পেলাম। প্রথমটায় ভয় খেয়ে আমি লাঠিটা নবীনের হাতে দিয়ে দিই।”
গ্যানা একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলে, “বিপদে পড়ে এখন মন্ত্রতন্ত্রের গল্প ফেঁদেছিস রে ছুঁচো! তোর একটা কথাও আমি বিশ্বাস করি না। এই, তোরা ওকে পিছমোড়া করে বাঁধ তো! বেশ কটকটে করে বাঁধবি কিন্তু।”
সর্দারের হুকুম তামিল করার ইচ্ছে থাকলেও জখম গুন্ডাদের তেমন উৎসাহ দেখা গেল না। সবাই যে-যার ব্যথা-বেদনায় কাতরাচ্ছে, ঘ্যাঙাচ্ছে, কোঁকাচ্ছে। বাঁধবার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। এমনকী কালু রামদাখানা তুলতে গিয়ে মাজায় খটাং করে শব্দ হওয়ায় ফের উঃ’ বলে বসে পড়েছে। নইলে নিমাইয়ের বিপদ ছিল।
নিমাই বলল, “শোনো সর্দার, আমি তো আর পালাচ্ছি না। আমার বিচার করার সময় পরে অনেক পাবে। তার আগে কাজের কথাটা হয়ে যাক।”
গ্যানা ধমকে ওঠে, “চোপ! তোর মতো বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গে আবার কাজের কথা কী রে উল্লুক? তুই বেইমান, নেমকহারাম, বজ্জাত, মিথ্যেবাদী!”
“যা বলতে চাইছি তা যদি খেয়াল করে শোনো, তা হলে আখেরে তোমার মস্ত লাভ হবে। আমার উপর বীরত্ব ফলিয়ে কী হবে? কথাটা শুনে তারপর যা হয় কোরো।”
“কী কথা?”
“লাঠি।”
“লাঠি! ফের লাঠি? তোর লজ্জা হচ্ছে না লাঠির নাম উচ্চারণ করতে? লেঠেলদের বংশে তুই তো কুলাঙ্গার।”
“না সর্দার, আমি ভাল লেঠেল। আর পাকা লেঠেল আমি খুব চিনি। ধরতাই দেখেই বুঝতে পারি। নবীন লেঠেল নয়, কিন্তু তার ওই লাঠির মধ্যে মস্ত কোনও লেঠেলের আত্মা লুকিয়ে আছে। আজ যা দেখলে এ তারই কাণ্ড। ওই লাঠি যদি তোমার হাতে আসে তা হলে গোটা পরগনায় তোমার সঙ্গে কেউ পাল্লা টানতে পারবে না। তোমার সাহস আছে, রোখও আছে, কিন্তু বুদ্ধি নেই, দেখার চোখও নেই। সত্যি কথাটা বললাম। এবার তোমার যা বিচার হয় তাই করো।”
গ্যানা একটু ধন্দে পড়ে গেল। তারও যেন কেন এখন মনে হচ্ছে, কাণ্ডটা স্বাভাবিক নয়। নবীন যদি লেঠেলও হয়ে থাকে, তবু তার দলের এত পাকা লোককে একা পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়াটা অশৈলী কাণ্ড। একটু ভেবে সে বলল, “খোঁজ আমি নিচ্ছি। তা বলে তুই কিন্তু রেহাই পাবি না। যদি আবোলতাবোল বলে ধোঁকা দিয়ে থাকিস, তা হলে যা-যা বলেছি তাই-তাই করব।”
“ঠিক আছে সর্দার। তবে এও বলে রাখছি, ও লাঠির দাম কিন্তু লাখ লাখ টাকা। আজকে যা ঘটল তা চাউর হতে বেশি সময় লাগবে না। বহু পাজি লোকের কানে কালকেই কথাটা চলে যাবে। তখন দেখো, ভাগাড়ে শকুন পড়ার মতো লোক এসে হামলে পড়বে লাঠিটা বাগানোর জন্য। দেরি করলে কিন্তু তুমি পস্তাবে।”
গ্যানা আর-একটু ভেবে বলল, “ঠিক আছে। আজ রাতেই লাঠিটা তুলে আনছি। ওরে কালু, কাউকে হরিপুরে এখনই পাঠিয়ে দে তো বাপু, লাঠিটা নিয়ে আসুক।”
হুকুম শুনে সবাই সিটিয়ে গেল। হরিপুর অনেকটা রাস্তা। কারওই শরীরের তেমন ক্ষমতা নেই যে, এখনই লাঠি চুরি করতে হরিপুর যাবে।
কালু বিমর্ষ মুখে বলে, “আমিই যেতাম সর্দার, কিন্তু মাজায় যা ব্যথা দু’কদম হাঁটার সাধ্যি নেই।”
অন্য কারওই হরিপুর যাওয়ার কোনও উৎসাহ দেখা গেল না। গ্যানার বিস্তর তর্জন-গর্জন এবং শেষে কাকুতি-মিনতি বা বকশিশের লোভেও না।
তখন নিমাই বলল, “আর কেউ যেতে না চাইলে আমি যেতে রাজি আছি।”
গ্যানা বলল, “তোকে বিশ্বাস কী? তুই শিয়ালের মতো চালাক। লাঠিটা হয়তো নিজেই বাগিয়ে নিবি।”
“তোমার তো বন্দুক আছে। যদি বেইমানি করি তা হলে গুলি করে আমাকে মেরো না হয়। লাঠি তো বন্দুকের সঙ্গে পারবে না।”
“তুই লাঠির যা ক্ষমতার কথা বলছিস তা যদি সত্যি হয়, তা হলে ওই লাঠি হয়তো বন্দুকের গুলিও ঠেকাতে পারবে।”
নিমাই হতাশ হয়ে বলল, “তা হলে কি লাঠিটা হাতছাড়া করবে সর্দার?”
গ্যানা গম্ভীর গলায় বলল, “না, না, তোকে ছেড়ে দিচ্ছি। শুধু একটা কথা মনে রাখতে বলি, যদি বেইমানি করিস তা হলে তোর গাঁয়ে গিয়ে রাতের বেলা তোর ঘরবাড়িতেই আগুন দেব। একটা লোকও বাঁচবে না। বুঝেছিস?”
নিমাইয়ের চোখ দুটো একবার যেন দপ করে জ্বলে উঠেই নিভে গেল। সে চাপা গলায় বলল, “ঠিক আছে।”
“তবে যা, কাল সকালের মধ্যে লাঠি আমার হাতে আসা চাই।”
নিমাই দ্বিরুক্তি না করে উঠে পড়ল। কেল্লার বাইরে এসে সে চারদিকটা একটু দেখে নিয়ে হনহনিয়ে হাঁটা ধরল।