নবীন ফের বলল, “আরে তা কেন? সঙ্গে একটু পোস্ত চচ্চড়িও তো খারাপ নয়! কী বলো!”
জগাই হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠল, “বাপ রে!”
“কী হল জগাইদা?”
“পোস্তর কথা কি আমাদের শুনতে আছে? ওসব বড়লোকের ব্যাপার, আমাদের শুনলেও পাপ।”
মাধাই বলল, “তা যা বলেছিস।”
নবীন ফের মৃদু হেসে বলল, “আহা, শুনতে দোষ কী? ধরো, ওই সঙ্গে যদি ফুলকপি দিয়ে তেলালো কই মাছের একখানা জম্পেশ ঝোল হয়, তা হলে?”
মাধাই মাথা নেড়ে বলে, “তা হলে বাঁচব না। ওসব হয় না রে নবীনভায়া। ও হচ্ছে রূপকথার গল্প।”
জগাইও মাথা নেড়ে বলে, “কই মাছ নাকি বর্ষাকালে খানিকটা গাছেও ওঠে। তা আমাদের ভাগ্যের কই মাছ গাছ ছেড়ে পাহাড়ের চুড়োয় গিয়ে উঠে বসে আছে।”
নবীন মিটিমিটি হেসে বলল, “কই মাছের পর কারও কারও নাকি আবার রুই মাছের কালিয়া চাখতে ইচ্ছে যায়।”
মাধাই বলল, “যায় নাকি? তা দুনিয়ায় কত পাগল আছে।”
জগাই বলল, “কালিয়া পর্যন্ত পৌঁছোনো বেশ শক্ত।”
নবীন বলল, “অবশ্য ওসব একটু বেশি রাতে। তার আগে কয়েকখানা গরম বেগুনি আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে ছোট ধামার একধামা করে লাল টাটকা মুড়ি খেতে কেমন লাগে বলো তো! মুড়ি খেলে খিদে মজে না, বরং একটু বাদে দ্বিগুণ চাগিয়ে ওঠে। তাই না?”
মাধাই বলল, “বুঝলি রে জগাই, নবীন কিন্তু জানে অনেক।”
জগাই সায় দিয়ে বলল, “তা জানবে না! কত লেখাপড়া শিখেছে! বারোঘরের নামতা জিজ্ঞেস করে দ্যাখো, মুখস্থ।”
.
ওদিকে কেল্লার একটা ঝুরঝুরে ঘরের ভিতরে দু’খানা মোমবাতি জ্বলছে। তার মৃদু আলোয় দেখা যাচ্ছে, যেন ঘরের মধ্যে একটা শোকসভা। কারও মুখে কথা নেই বটে, তবে ‘উঃ’, ‘আ’, ‘গেলুম রে’ ইত্যাদি চাপা কাতরধ্বনি শোনা যাচ্ছে। জনাচারেক মেঝেতে সটান শুয়ে কাতরাচ্ছে। যারা বসে বা দাঁড়িয়ে আছে তাদের অবস্থাও সুবিধের নয়। কারও কপালে কালশিটে, কারও কনুই ভাঙা, কারও পায়ে জখম, কারও মাথায় রক্ত জমে ঢিবি হয়ে আছে। দু’থাক ইটের একটা পাঁজার উপর গম্ভীর মুখে নিজের বাঁ হাতের কবজি ডান হাত দিয়ে চেপে ধরে বসে আছে গ্যানা। অনেকক্ষণ কারও মুখে কথাটথা নেই।
এতক্ষণ দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে যাচ্ছিল গ্যানা। এইবার কথা কইল। বলল, “ওরে, তোরা খোঁজ নে তো, কাশী না গয়া কোন জায়গাটা ভাল হবে।”
গ্যানার ডান হাত কালু এতক্ষণ বসে বসে কোঁকাচ্ছিল। এবার চোখ তুলে বলল, “কেন ওস্তাদ?”
“আর কি এ সমাজে মুখ দেখানোর জো রইল রে আমার? নাঃ, সব ছেড়েছুঁড়ে কাশীবাসী না হয়ে আমার আর উপায় নেই। একটা পুঁচকে ছোঁড়ার হাতে এতগুলো ঘায়েল হলুম! ছিঃ ছিঃ, কী লজ্জার কথা! গত দশ বছরে আমাকে কেউ হাতে-হাতে লড়াইয়ে জখম করতে পারেনি। সেই গ্যানা ওস্তাদের কবজি ভেঙে দিয়ে গেছে সেদিনকার দুধের ছোঁকরা! গলায় দড়ি দিলে নাকি মরার পর গতি হয় না, নইলে তাই দিতুম। ওরে কালু, কালকেই কাশী বা গয়া যে জায়গা ভাল হয় তার একখানা টিকিট কেটে আনবি। আর এ-সংসারে নয় রে। আর আমার মুখ দেখানোর উপায় রইল না। বুক ফুলিয়ে গায়ে-গঞ্জে ঘুরে বেড়াতাম, হাজারটা লোক সেলাম ঠুকত। এখন দুয়ো দেবে। ছেলেরা ছড়া কাটবে। আমার গলায় জুতোর মালা পরাবে এবার। সেই অপমান আমার সহ্য হবে না।”
কালু ভাঙা গলায় বলল, “আপনি কাশীবাসী হলে যে দল ভেঙে যাবে সর্দার। আমরা যে না খেতে পেয়ে মরব।”
“সেটাই তোদের প্রায়শ্চিত্ত। আজ যা বীরত্ব দেখালি তাতে তোদের অনশনে মরাই উচিত।”
কালু হঠাৎ তেড়ে উঠে বলল, “সর্দার, সব দোষ ওই নিমাইয়ের, ওই তো আমাদের বলেছিল যে, এবারের শিকার একদম জলভাত। হুড়ো দিলেই নাকি টাকার বান্ডিল বের করে দিয়ে হাতে-পায়ে ধরে প্রাণটা ভিক্ষে চাইবে।”
নিমাই এতক্ষণ একধারে দেওয়াল ঘেঁষে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসে ছিল। তারও মাজায় চোট হয়েছে। সনাতন ওস্তাদের চেলা হয়ে কিনা সে মার খেয়েছে জগাই-মাধাইয়ের মতো আনাড়ির কাছে! ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না। বড্ড ভাবিয়ে তুলেছে।
গ্যানা রক্ত চক্ষুতে নিমাইয়ের দিকে চেয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, “কালু, রামদাখানা কার কাছে রে? ওটা নিয়ে আয়। এটাকে আজ দু’ আধখানা করে কাটলে তবু খানিক জ্বালা জুড়োবে। কেটে কেল্লার পিছনের পুরনো ইদারায় ফেলে দে।”
কথাটা শুনে নিমাই হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলল, “গ্যানা, তুমি একটা আহাম্মক।”
গ্যানা তাজ্জব হয়ে অপলক চোখে নিমাইয়ের দিকে চেয়ে বলল, “কী বললি? আহাম্মক না কী যেন! হ্যাঁ রে কালু, ঠিক শুনেছি তো, নাকি কানটা গড়বড় করছে?”
কালু দাঁত কড়মড় করে রামদাখানা পাশ থেকে টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, “ঠিকই শুনেছেন। গলা কাটবার আগে ওর জিভটা কেটে ফেলব, তারপর দশ মিনিট বাদে গলা।”
নিমাই বুঝল, সামনে ঘোর বিপদ! সে বলল, “দাঁড়াও, আগে কথাটা শুনে নাও। তারপর গলা কেন, যা খুশি কেটো।”
গ্যানা হুংকার দিয়ে বলে, “কী কথা রে তোর মর্কট? তুই নাকি মস্ত লাঠিবাজ, সনাতন ওস্তাদের চেলা! তা নিজে লেঠেল হয়ে আর একজন লেঠেলকে চিনতে পারলি না! বলে দিলি জলভাত? তা সেই জলভাত দুধের ছোঁকরা যে আমাদের মতো ষণ্ডাদের পিটিয়ে ঢিট করে দিল তা দেখে তোর লজ্জা হচ্ছে না? মরতে ইচ্ছে যাচ্ছে না? মুখে চুনকালি মেখে বেড়ানো উচিত বলে মনে হচ্ছে না?”