“হ্যাঁ, হ্যাঁ, অনেকক্ষণ।”
“মরার আগেই যেন পেরিয়ে না যায়, দেখিস!”
“না না, সে আমার খুব খেয়াল আছে।”
ফের ধুন্ধুমার সব শব্দ হতে লাগল। কী হচ্ছে নবীন ঠিক বুঝতে পারছিল না। শুধু এটা বুঝতে পারছে যে, এরকম হওয়ার কথা ছিল না। এ যা হচ্ছে তা একেবারে হিন্দি ছবির ঝাড়পিট।
তবে এ-ও বোঝা যাচ্ছিল প্রতিপক্ষ একটু একটু করে পিছু হটছে। আবছায়ায় একটা লোককে দেখা গেল, ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে পালাচ্ছে, একজন মাথা চেপে ধরে ‘বাপ রে, চোখে যে অন্ধকার দেখছি’ বলে দিকশূন্য দৌড়ে হাওয়া হল। একজন পেট চেপে ধরে বসে পড়ে তারপর হামাগুড়ি দিয়ে গায়েব হল, একজন ‘আর পারি না বাপ’ বলে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে অকুস্থল ত্যাগ করল। শেষ পাঁচ-সাতজন কিছুক্ষণ লড়াই দিয়ে আচমকা সব ক’টা একসঙ্গে কেল্লার দিকে ছুটতে লাগল। তারপর সব ভোঁ ভাঁ। শুধু বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে আছে জগাই মাধাই।
বিস্মিত নবীন হাঁ হয়ে কিছুক্ষণ পরিস্থিতিটা বোঝবার চেষ্টা করল। যা ঘটে গেল তা কি সত্যি? স্বপ্ন দেখছে না তো? অনেকক্ষণ লাঠি চালিয়ে একটু হাঁফিয়ে গেছে সে। বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিয়ে সে জগাই আর মাধাইয়ের দিকে চেয়ে করুণ গলায় বলল, “কী হল বলো
তো জগাইদা, মাধাইদা? কিছু বুঝলে?”
জগাই-মাধাই সবেগে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে এক বাক্যে বলল, “কিছুই বুঝতে পারলুম না।”
মাধাই হ্যাদানো গলায় বলল, “মাহেন্দ্রক্ষণটা কি পেরিয়ে গেল নাকি রে জগাই?”
“তা গেল বোধ হয়।”
“ইস, আমাদের তো দেখছি মরাই হল না! ভাল যোগটা ছিল রে!”
“আহা, মাহেন্দ্রক্ষণে বেঁচে থাকাটাও কি খারাপ মাধাইদা?”
“বেঁচে থেকে হবেটা কী বল! আমাদের কি কোথাও ঠাঁই আছে? পানুবাবুর অত্যাচারে বাপ-পিতেমোর ভিটে ছাড়তে হচ্ছে, কোথায় যাব, কী খাব তারই ঠিক নেই। বরং মরলে ফের আঁটঘাট বেঁধে জন্মানো যেত।”
“না গো মাধাইদা। আগে তাই মনে হচ্ছিল বটে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমরাও কম যাই কীসে? গা বেশ গরম হয়েছে আমার। তিনটে বদমাশকে যা ঢিট করেছি তা আর কহতব্য নয়। মার খেয়ে এমনভাবে তাকাচ্ছিল যেন ভূত দেখছে!”
মাধাই বলল, “তা গা আমারও গরম হয়েছে বটে। আমি তো শাবল দিয়ে একটার হাঁটু ভেঙেছি, একজনের কনুই, তিন নম্বরটার ঘাড়টাই গেছে বোধ হয়।”
“তবেই বোঝে। আমাদের ভিতরে যে এত খ্যামতা ছিল, তা কি আমরাই এতদিন বুঝতে পেরেছি?”
“তা বটে। তবে এত মেহনতের পর খিদেটা যখন চাগাড় দেবে তখনই যে মুশকিল।”
নবীন একটু ধাতস্থ হয়েছে। পায়ের কাছে একটা টর্চ পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সেটা কুড়িয়ে নিয়ে আলো জ্বেলে হাতের লাঠিটা খুব মন দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল। এতক্ষণ এই লাঠির ভিতর থেকে যে মন্ত্রোচ্চারণ হচ্ছিল সেটা এখন আর নেই। সাধুর দেওয়া লাঠি, কী জাদু আছে এর ভিতরে কে জানে! তবে এ যে যেমন-তেমন লাঠি নয় তা সে খুব বুঝতে পারছে। লাঠিটা দু’হাতে আড় করে ধরে ভক্তিভরে কপালে ঠেকাল সে।
তারপর জগাই আর মাধাইয়ের দিকে ফিরে বলল, “তোমাদের কী হয়েছে জগাইদা?”
“না, এই মাধাইকে বলছিলাম আর কী, গা-টা বেশ গরম হয়েছে।”
“তোমরা এই বিপদের মধ্যে হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলে বলো তো!”
মাধাই বলল, “সে অনেক কথা রে ভাই। তবে তোমার যে এলেম দেখলাম তাতে আমাদের আর হাত লাগানোর দরকার ছিল না।”
নবীন বলল, “ধুস, কিছুই দ্যাখোনি। আমি কখনও লাঠিটাটি খেলিনি, মারপিটও করিনি। ও আমার কোনও কেরদানি নয় গো। অন্য ব্যাপার আছে।”
“কী ব্যাপার বলো তো!”
“তা আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না। কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল!”
মাধাই বলল, “এখন আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না। গুন্ডা বদমাশদের বদ মতলব ফের চাড়া দিতে পারে। এইবেলা রওনা হয়ে পড়ো। হরিপুর এখনও অনেকটা পথ।”
“তোমরা না খিদের কথা বলছিলে?”
জগাই লাজুক গলায় বলল, “ও কিছু নয়। আমাদের যখন-তখন খিদে পায়, সয়েও যায়। ওসব হচ্ছে দেখন-খিদে। একপেট জল খেলেই খিদে উধাও হবে।”
মাধাইও সায় দিয়ে বলল, “ও ঠিক খিদেও নয়। একটু ফাঁকাকা ভাব হয় আর কী! তুমি বরং এগিয়ে পড়ো, আমরাও গঞ্জের দিকে ফিরি।”
নবীন মাথা নেড়ে বলে, “সেটি হচ্ছে না। এই বিপদের মধ্যে আমাকে ফেলে যদি চলে যাও তোমাদের কিন্তু অধর্ম হবে।”
জগাই আর মাধাই পরস্পরের দিকে একটু মুখ তাকাতাকি করে নিল। তারপর জগাই একটু হেসে বলল, “তা অবিশ্যি ঠিক। ভুরফুনের মাঠে শুধু চোর-ডাকাতই তো নয়, তেনারাও আছেন। কী বলো মাধাইদা?”
“আর বলিসনি। দুটো যা স্যাম্পেল দেখলাম, তাতেই পিত্তি চটকে গেছে। না হে নবীনভায়া, তোমাকে একা ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। চলো, বরং তোমাকে হরিপুর অবধি এগিয়েই দিয়ে আসি। ফিরতে একটু রাত হবে। তবে আমাদের আর কিবা দিন, কিবা রাত্রি, কী বলিস রে জগাই?”
“তা যা বলেছ।”
তিনজনে রওনা হয়ে পড়ল। নবীনের হাতে লাঠি, দু’জনের হাতে শাবল। হাঁটতে হাঁটতে নবীন হঠাৎ বলল, “আচ্ছা গরম রাঙা চালের ভাতের উপর যদি সোনামুগের ডাল ঢালা হয় তা হলে কেমন শোভা হয় বলো তো?”
জগাই সুড়ুত করে জিভের জল টেনে নিয়ে বলল, “ওঃ, সে একেবারে মারদাঙ্গা ব্যাপার।”
নবীন একটু হেসে বলল, “সঙ্গে দু-চারটে ঝাল কঁচালঙ্কা, না?”
মাধাই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “ওতেই ভাত সাবাড়।”