“তা জানি না। দাঁড়াও, ভাল করে শুনে বলছি। সংস্কৃত তো আর জানা নেই, উচ্চারণ ভুল হতে পারে। এই তো! হ্যাঁ বলছে, মা ম্রিয়স্ব, মা জহি, শকশকশ্যতে চেৎ মৃত্যুমঅবলোপয়। এর মানে জানো?”
“না।”
ফের কিছুক্ষণ শুনে নিমাই বলল, “আরও বলছে যেনাত্মনস্তথান্বেষাং জীবনং বৰ্দ্ধনং চ অপি প্রিয়তে সঃ ধর্মঃ। দদদদ দদাতু জীবনবৃদ্ধি নিয়-নিয়তং স্মৃতিচিদযুতে। বুঝতে পারলে কিছু?”
“না তো! কিন্তু আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না কেন?”
নিমাই দাঁড়িয়ে উদভ্রান্তের মতো চারদিকে চাইতে লাগল, তারপর ভয়-খাওয়া গলায় বলল, “ভূতুড়ে গলাটা কোথা থেকে আসছে বলো তো?”
“জানি না তো নিমাইদা।” ঠিক এই সময়ে কেল্লার দিক থেকে একটা জোরালো টর্চবাতির আলো জ্বলে উঠেই নিভে গেল।
নবীন চমকে উঠল, বলল, “নিমাইদা, কেল্লায় টর্চ জ্বালল কে?”
নিমাই উদভ্রান্তের মতো চারদিকে চেয়ে হঠাৎ কাঁধ থেকে লাঠিটা নামিয়ে সেটার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর চাপা গলায় বলল, “এ লাঠি কোথায় পেয়েছ?”
“একজন দিয়েছে। কেন বলুন তো!”
নিমাই সভয়ে বলে উঠল, “এই লাঠির ভিতর থেকেই মন্তরের শব্দ আসছে। কানের কাছে নিয়ে দ্যাখো, শুনতে পাবে।”
নবীন লাঠিটা নিয়ে ডান কানে ছোঁয়াতেই শুনতে পেল, গম্ভীর সুরেলা একটা গলা মন্ত্র পাঠ করছে, “মা শ্রিয়স্ব মা জহি, শক্যতে চেৎ মৃত্যুমঅবলোপয়। যেনাত্মস্তথান্বেষাং জীবনং বৰ্দ্ধনং চ অপি প্ৰিয়তে সঃ ধর্মঃ। দদাতু জীবনবৃদ্ধি নিয়তং স্মৃতিচিদযুতে।”
নিমাই ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলল, “ওটা ভুতুড়ে লাঠি। যদি বাঁচতে চাও তো ফেলে দাও।”
নবীন কিন্তু আদপেই ঘাবড়াল না। বরং লাঠিটা বেশ শক্ত করে ধরে কাঁধে ফেলে বলল, “এটা আমার কাছেই থাক।”
নিমাই কেমন উদভ্রান্তের মতো বলল, “না না, ওটা ফেলে দেওয়াই ভাল, কাছে রাখা ঠিক হবে না। এসব জিনিস ভাল নয়।”
নবীনের হঠাৎ যেন জেদ চেপে গেল। সে গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে বলল, “এটা আমার লাঠি, আমার কাছেই থাকবে।”
ঠিক এই সময়ে কেল্লার দিক থেকে চার-পাঁচটা টর্চের আলো এসে সামনের পথে পড়ল।
নবীন থেমে সভয়ে সেই দিকে চেয়ে নিজের ট্যাঁকে হাত রাখল। ত্রিশ হাজার টাকা গ্রামদেশে বড় কম টাকা নয়। টর্চের আলোগুলো তার ভাল ঠেকছে না। এই নির্জন মাঠের মধ্যে হঠাৎ টর্চের আলো মানেই বিপদ সংকেত।
“নিমাইদা, দেখতে পাচ্ছেন?”
নিমাই গম্ভীর গলায় শুধু বলল, “হুঁ।”
টর্চের আলো তাদের দিকেই বেশ ধেয়ে এল। আলোর পিছনে ছায়ামূর্তির মতো দশ বারোজন লোক। আবছায়াতেও তাদের হাতে লাঠিসোঁটা দেখতে পেল নবীন। হঠাৎ গলাটা শুকিয়ে গেল তার, হাতে-পায়ে খিল ধরার অবস্থা।
“ওরা কারা নিমাইদা?”
“বুঝতে পারছি না। মতলব খারাপও হতে পারে। ওরা দশ বারোজন আছে, হাতে অস্ত্র।”
“তা হলে?”
“আমরা তো ওদের সঙ্গে পেরে উঠব না নবীন। চাইলে যা আছে দিয়ে দিয়ো। আর হাতে লাঠি দেখলে কিন্তু ওরা বিগড়ে যাবে, হাতের অস্তর চালিয়ে দেবে। তুমি বরং লাঠি ফেলে হাতজোড় করে দাঁড়াও।”
নবীনের কেমন যেন সেরকম করতে ইচ্ছে হল না। সে বরং লাঠিটা আরও জোরে চেপে ধরে বলল, “আগে তো দেখি ওরা কারা!”
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দৌড়পায়ে এসে লোকগুলো তাদের ঘিরে ফেলল। ওদের টর্চের আলোতেই নবীন দেখতে পেল, শুধু লাঠিই নয়, ওদের হাতে বড় বড় ছোরা, দা, বল্লম আর বন্দুকও আছে। এরা কারা তা বুঝতে আর কোনও কষ্ট নেই।
একটা লম্বা লোক দল থেকে দু’পা এগিয়ে এসে গম্ভীর হিংস্র গলায় বলল, “হাতে লাঠি কেন রে তোর? মারবি নাকি রে? অ্যাঁ! মারবি?”
নবীন বলল, “আজ্ঞে না।”
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ও কথাটা সে বললেও মুখ দিয়ে কিন্তু বেরোল সম্পূর্ণ অন্য কথা, “দরকার হলে মারব।”
লোকটা অবাক হয়ে দু’সেকেন্ড তার দিকে বড় বড় চোখে চেয়ে থেকে হঠাৎ হাঃহাঃ করে হেসে বলল, “বাপ রে! সত্যিই মারবি? আমার যে বড্ড ভয় করছে রে!”
নবীন কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “আমাকে ছেড়ে দিন। টাকাপয়সা দিয়ে দিচ্ছি, জানে মারবেন না।” কিন্তু এবারেও আশ্চর্যের বিষয় তার মুখ দিয়ে ও কথা না বেরিয়ে বেশ গম্ভীর আওয়াজে বেরোল, “ভয় পাওয়াই তোমার পক্ষে ভাল।”
“বটে!” বলে গ্যানা গম্ভীর হল।
তারপর বলল, “শোন, আজ রাতেই আমার আরও তিনটে ডাকাতি আছে। নইলে তোর সঙ্গে আরও একটু রগড় করতাম। মারধর, রক্তারক্তি করতে চাইনা, ট্যাঁকে যা আছে দিয়ে যা।”
নবীন ট্যাঁকের দিকে হাত বাড়াল বটে, কিন্তু হাতটা ওদিকে মোটে যেতেই চাইল না। লাঠিটা ডান হাতে ধরা ছিল,এবার বাঁ হাতটাও এসে চেপে ধরল সেটা। তারপর হাতেরা দু’ভাই লাঠিটা আস্তে আস্তে উঁচু করে তুলে ধরতে লাগল।
ঠিক এই সময়ে কোথা থেকে দুটো উটকো লোক দুটো শাবল উঁচিয়ে তেড়ে আসতে আসতে চেঁচাচ্ছিল, “কোথাও ভয় নেই রে নবীন, এই আমরাও তোর সঙ্গেই মরব। এসে গেছি রে?”
এই চিৎকারে ডাকাতেরা ভারী অবাক হল, খানিকটা হকচকিয়েও গেল। গ্যানা বজ্রকণ্ঠে বলল, “চালা অস্তর! নিকেশ কর সব ক’টাকে!”
চোখের পলকে চারদিক থেকে লাঠির বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। আবছায়া আলোয় কিছুই ভাল দেখা যাচ্ছিল না। নবীন শুধু বুঝতে পারল তার দু’হাতে ধরা লাঠিখানা বিদ্যুৎগতিতে চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর খটাখট শব্দ তুলছে। মাঝে মাঝে বাপ রে’, ‘উঃ’, ‘ওরে বাবা’ এরকম সব আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল। তার মধ্যেই কে যেন হেঁকে বলল, “মাহেন্দ্রক্ষণ কি শুরু হয়েছে রে জগাই?”