বিস্ময়ে ফটিকের মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়। সে বিড়বিড় করে শুধু বলল, “ষোলোজন ফটিক ঘোষ?”
নটবর রায় বললেন, “হ্যাঁ পাক্কা ষোলোজন। কে আসল কে নকল তার বিচার করার মতো সময় আমার নেই। যদি পোস্টকার্ড দেখাতে পারো তবেই বুঝব আসল লোকটা কে। তা হলে এবার তোমরা এসে গিয়ে। আমার জরুরি কাজ আছে।”
নিতাই এবার একটু সাহস করে বলল, “আচ্ছা, সবাই ফটিক ঘোষ হতে চাইছে কেন জানেন?”
নটবর রায় মাথা নেড়ে বললেন, “না হে বাপু, আমি জানি না।” ফটিক করুণ মুখ করে বলল, “পিসির সঙ্গে একটু দেখা–”
“না হে বাপু, দেখা হওয়া সম্ভব নয়। কে কার পিসি তারই ঠিক নেই। তোমরা এবার এসো।”
দু’জনে গুটি গুটি বেরিয়ে এল। দুদিন ধরে খানিক ট্রেন, খানিক বাস, তারপর মাইলের পর মাইল হেঁটে লবেজান হয়ে এত দূর আসার যে কোনও মানেই হল না, সেটা বুঝতে পেরে ফটিকের পা চলছিল না। সে অসহায় গলায় বলল, “নিতাই, কিছু বুঝতে পারলি?”
“না। তবে একটা ষড়যন্ত্র আছে বলে মনে হচ্ছে।”
“কীসের ষড়যন্ত্র?”
“সেটাই ভাবছি। ষড়যন্ত্র না থাকলে মহাদেব দাস তোর কাছ থেকে চিঠিটা চালাকি করে হাতিয়ে নিত না।”
“সেটা আমারও মনে হচ্ছে, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না। পিসির বাড়িতে ভাইপো আসবে, তার মধ্যে এত ভেজাল কীসের রে বাবা! আগে জানলে কখনও এত কষ্ট করে আসতাম না।”
ফটকের কাছে ভোজপুরি দরোয়ানটার সঙ্গে দেখা। খুব আহ্লাদের গলায় বলল, “কী খোকাবাবু, জান পহচান হোলো?”
ফটিক মাথা নেড়ে বলল, “না দরোয়ানজি, উনি আমাদের পাত্তা দিলেন না। কী ব্যাপার বলতে পারেন?”
“সো হামি কুছু জানি না। লেকিন রোজ দু-চারটো করে ফটিক ঘোষ আসছে বাবুজি। ইতনা ফটিক ঘোষ কভি নেহি দেখা। নাটা ফটিক ঘোষ, লম্বা ফটিক ঘোষ, মোটা ফটিক ঘোষ, রোগা ফটিক ঘোষ, কালা ফটিক ঘোষ, ফর্সা ফটিক ঘোষ। রোজ আসছে। উসি লিয়ে বড়াবাবু কুছ পারসান মালুম হোতা।”
ফটক পেরিয়ে দু’জন ফের রাস্তায় পড়ল।
ফটিক বলল, “এখন কী করা যায় বল তো! সন্ধে হয়ে গেছে, এখন তো আর ফিরে যাওয়া যায় না। রাতটা এখানেই কাটাতে হবে যে।”
নিতাই বলল, “ভাবিস না। একটা রাত ঠিক কাটিয়ে দেওয়া যাবে। এখন চল, জায়গাটা একটু ঘুরেফিরে দেখি।”
ফটিক দাঁত কড়মড় করে বলল, “মহাদেব দাসকে এখন পেলে তার মুণ্ডুটা ছিঁড়ে ফেলতাম। ওই লোকটার জন্যই তো এত হেনস্থা হতে হল।”
নিতাই বলল, “মাথা গরম করে লাভ আছে কিছু? দোষ তো তোরই। তুই চিঠিটা ফস করে দিয়ে ফেললি।”
“তখন কি জানি চিঠি না নিয়ে এলে পিসির বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। তা ছাড়া আমরা তো ফিরেই যাচ্ছিলাম।”
“যাক গে, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন চোখকান খোলা রেখে চল তো, আমি একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি।”
ক্লান্ত শরীরে তারা বেশি ঘুরতে পারল না। তবে দোগেছে যে বেশ ভাল জায়গা, সেটা বোঝা গেল।
নিতাই বলল,”গনা ডাইনির ফলার হজম হয়ে আমার এখন বেশ খিদে পাচ্ছে।”
ফটিক বলল, “আমারও। চল, ওখানে একটা বেশ ঝকঝকে মিষ্টির দোকান দেখা যাচ্ছে।”
মিষ্টির দোকানটায় বেশ ভিড়। সামনে পাতা বেঞ্চে কয়েকজন লোক বসে গল্পটল্প করছে। তারা দু’জন দোকানের কাছাকাছি এগোতেই দোকানের এক ছোঁকরা কর্মচারী বলে উঠল, “ওই যে, ফটিকবাবু এসে গেছেন।”
নিতাই ফটিককে একটা ঠেলা দিয়ে বলল, “তুই এখন বিখ্যাত লোক।”
ফটিক গম্ভীর হয়ে বলল, “তাই দেখছি।”
কর্মচারীটা হাসিমুখে বলে উঠল, “ফটিকবাবু তো? পায়রাডাঙার হরিহর ঘোষের ছেলে ফটিক ঘোষ?”
যারা বেঞ্চে বসে ছিল তারা তাদের দিকে খুব তাকাতে লাগল। একজন বলে উঠল, “ওঃ, এই কয়েকদিনে যা ফটিক ঘোষ দেখলুম এমনটা আর জন্মেও দেখব না। দেশে কত ফটিক ঘোষ আছে রে বাবা!”
একজন বুড়োমানুষ বলল, “কেন হে, এই আমাদের দোগেছেতেই তো চারজন সুধীর রায় আছে। তারপর ধরে বৈরাগী মণ্ডল আছে তিনজন, পাশের গাঁ নয়নপুরে নরহরি দাস আছে পাঁচজন।”
একজন বলল, “আহা, তা বলে তো পনেরো-বিশজন করে নয়। আর সবারই বাপের নামও এক নয়।”
উত্তেজিত আলোচনা ক্রমে তর্কে দাঁড়িয়ে গেল। কেউ আর তাদের খেয়াল করল না। দু’জনে ভরপেট মিষ্টি খেয়ে নিল। নিতাই কর্মচারীটাকে জিজ্ঞেস করল, “ভাই, এখানে কোথাও রাতে থাকার একটু জায়গা হবে?”
কর্মচারীটা বলল, “এখানে তো হোটেল টোটেল নেই। তবে সামনে এগিয়ে গিয়ে বাঁ দিকের পথ ধরলে চণ্ডীমণ্ডপ দেখতে পাবে, সেখানে থাকা যাবে।” দু’জনে উঠে পড়ল। চণ্ডীমণ্ডপটা খুঁজে পেতেও বেশি ঘোরাঘুরি করতে হল না। বেশ বড় আটচালা, চারদিক খোলা, তবে মেঝেটা বাঁধানো, সারাদিনের ক্লান্তির পর দু’জনে দু’খানা চাঁদর পেতে শুয়ে পড়ল। এত ক্লান্ত যে, কথাবার্তাও আসছিল না তাদের। শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়ল।
৪. মাঝরাতে পায়ে সুড়সুড়ি
মাঝরাতে পায়ে সুড়সুড়ি লাগায় ধড়মড় করে উঠে বসল ফটিক, ঘুমচোখে দেখল, পায়ের কাছে একটা লোক বসে আছে। সে তাড়াতাড়ি টিনের তোরঙ্গটা আঁকড়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠল, “চোর! চোর!”
সেই চিৎকারে নিতাইও ঘুম ভেঙে উঠে বসল, “কোথায় চোর? কে চোর?”
“ওই যে চোর, দেখছিস না!” লোকটা ভারী বিরক্তির গলায় বলল, “ওঃ, কী চিল-চেঁচানিটাই চেঁচাচ্ছে দ্যাখ, যেন ডাকাত পড়েছে! তা চোর বলে কি পচে গেছি নাকি?”
লোকটার সাহস দেখে ফটিক হাঁ। তারপর একটু সামলে নিয়ে বলল, “চোরের চেয়ে ডাকাত অনেক ভাল। তারা পা টিপে টিপে আসে না, উঁকিঝুঁকি মারে না, পায়ে সুড়সুড়ি দেয় না। চোরের হাবভাব অনেকটা ভূতের মতো। আর ডাকাতরা অনেক বীর, তারা বুক ফুলিয়ে আসে।”