মন্ত্র পড়া শেষ করে ঠাকুরমশাই বলে উঠলেন, “তাড়াতাড়ি কেটে ফেল বাবা, সতীশ দারোগা কখন হানা দেয় তার ঠিক নেই।”
যে ঢাক বাজাচ্ছিল সে দৌড়ে গিয়ে একটা মাটির সরা এনে নিতাইয়ের মুখের নীচে পেতে দিল, বোধ হয় এতে করেই কাটা মুণ্ডুটা নিয়ে গিয়ে অষ্টভুজাকে ভোগ দেবে।
দ্রিমি দ্রিমি করে ঢাক বাজতে লাগল। নিতাইয়ের মনে পড়ল, বলির সময়ে এরকম বাজনাই বাজে বটে। ভয়ে সে চোখ বুজে ফেলল। নাঃ, অষ্টভুজার মন্দিরের কাঁপালিককে চটানোটা বড্ড আহাম্মকিই হয়ে গেছে।
ঠাকুরমশাই জলদগম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, “জয় মা! এবার ঘ্যাচাং করে দাও হে গদাইচাঁদ।”
“আজ্ঞে বাবা।” বলেই খাঁড়াটা ওপরে তুলল বলাই।
খাঁড়াটা নেমেও এল বটে, তবৈ বেশ আস্তে। নিতাই ঘাড়ে একটু চিনচিনে ব্যথা টের পেল। তার গলা বেয়ে দু’ফোঁটা রক্তও পড়ল সরায়।
লোকটা খাঁড়াটা ফেলে হাড়িকাঠের খিল খুলে দিয়ে হাত পায়ের বাঁধন আলগা করে নিতাইকে দাঁড় করিয়ে একগাল হেসে বলল, “তোর বড় ভাগ্য, মায়ের কাছে বলি হলি, তোর চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার পেয়ে গেল।”
ঠাকুরমশাই সরাটা তুলে নিয়ে ভক্তিগদগদ গলায় “জয় মা, এই যে নররক্ত এনেছি মা, নে মা …. নে মা …” বলতে বলতে মন্দিরে ঢুকে গেল।
নিতাই ঘাড়ে হাত বুলিয়ে বলল, “বলি হয়ে গেলুম নাকি? কিন্তু ঘাড়টা তো আস্তই আছে।”
বলাই একটু হেসে বলল, “এর বেশি বলি দেওয়ার কি উপায় আছে রে? সতীশ দারোগা নিয়ে গিয়ে ফাটকে পুরবে যে। তারপর ফাঁসিতে ঝোলাবে। আসলে বলি হত ঠাকুরমশাইয়ের পিতামহের আমলে। এখন যা হয় তাকে কী একটা বলে যেন, পতিক না পরীক কী যেন।”
“প্রতীক নয় তো!”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ওইটেই। বলিও হল, ঘাড়ও আস্ত রইল, মাও নররক্ত পেয়ে খুশি হয়ে গেলেন।”
ঢাকি লোকটা একটু তুলোয় করে আয়োডিন এনে তার ঘাড়ের কাটা জায়গাটায় লাগিয়ে বলল, “এবার কেটে পড়ো তো বাপু, সতীশ দারোগা এসে পড়লে কিন্তু সবাইকে থানায় নিয়ে যাবে।”
হতবুদ্ধি নিতাই তাড়াতাড়ি রওনা হল। বাঁশবনের মধ্যে ফটিকের সঙ্গে দেখা। ভয়ে কাঁপছে।
“তুই যে বলি হলি? ভূত নোস তো৷”
“তাও বলতে পারিস।”
“ওরে বাবা–“
হঠাৎ একটা বাঁশের ডগা মটমট করে দুলে উঠল, ওপর থেকে কে একজন হেঁড়ে গলায় বলে উঠল, “কে রে, কোন ভূত ঢুকেছিস আমাদের বাঁশবনে?”
দু’জনেই ভয়ে হিম হয়ে গেল। নিতাই কাঁপা গলায় কোনও রকমে বলল, “আমরা ভূতটুত নই, নিতান্তই মনিষ্যি।”
বাঁশের ডগাটা আবার নড়ল। হেঁড়েগলা বলল, “অ, তুই তো একটু আগে অষ্টভুজার মন্দিরে বলি হলি।”
“যে আজ্ঞে।”
“তা তোর কপালটা ভাল, আমাদের কপাল তত ভাল ছিল না। ওই হরু ঠাকুরের ঠাকুর্দা বীরু কাঁপালিকের হাতে আমরা সত্যিই বলি হয়েছিলাম। সেই থেকে কবন্ধ হয়ে এই বাঁশবনে থানা গেড়েছি।”
নিতাই সভয়ে জিজ্ঞেস করল, “হা-ডু-ডু খেলতে হবে নাকি? শুনেছি, আপনারা মানুষ পেলে হা-ডু-ডু খেলেন।”
“সে খেলতুম রে। মনসাপোতার জয়নাথ পণ্ডিত আমাদের একটা দাবা আর খুঁটি কিনে দিয়েছে। খেলাটাও শিখে নিয়েছি। আহা, দাবার মতো খেলা নেই। হা-ডু-ডু আবার একটা খেলা? যা, তোরা, আমার মন্ত্রী এখন ঘোড়ার মুখে পড়েছে।”
দু’জনে হুড়মুড় করে বাঁশবনটা পেরিয়ে করালেশ্বরীর খালের ধারে এসে পড়ল। কিন্তু কোথায় খাল! শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে আছে। খালের ভেতর দিয়ে পায়েচলার রাস্তা। ফটিক হাঁফ ছেড়ে বলল, “যাক বাবা, দড়িতে ঝুলে পেরোতে তো হবে না।”
সন্ধে হয়ে আসছে। ওপারেই দোগেছে।
খালটা যখন প্রায় পেরিয়ে এসেছে তখন দেখা গেল একটা লোক উবুহয়ে বসে আছে। তার পায়ের কাছে অনেক গোদা গোদা টিকটিকি, লোকটা একটা খালুই থেকে চুনোমাছ বের করে টিকটিকিদের খাওয়াচ্ছে। আর তারাও মহানন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে খাচ্ছে।
দৃশ্যটা দেখে দাঁড়িয়ে গেল দুজন।
ফটিক বলল, “লোকটার বড্ড দয়ার শরীর, টিকটিকিদের মাছ খাওয়াচ্ছে দ্যাখ।”
লোকটা মুখ তুলে বলল, “টিকটিকি নয় গো, টিকটিকি নয়।”
“তবে?”
“এরা সব হল করালেশ্বরীর বিখ্যাত কুমির। একসময়ে দশ বিশ হাত লম্বা ছিল। আস্ত আস্ত গোরু মোষ ছাগল কপাত কপাত করে গিলে ফেলত। তা করালেশ্বরীর খাল হেজেমজে গেল, আর কুমিরগুলোও না খেতে পেয়ে শুকিয়ে শুকিয়ে সব একটুখানি হয়ে গেল। তাদের বাচ্চাগুলোও ছোট ঘোট হতে লাগল। তস্য বাচ্চাগুলো আরও ছোট হতে লাগল। হতে হতে এই দশা।
“কুমির?” বলে ফটিক এক লাফে উঁচু ডাঙায় উঠে গেল।
লোকটা বলল, “ভয় নেই গো, ওদের কি আর সেই দিন আছে? এখন চুনোমাছের চেয়ে বড় কিছু খেতেই পারে না। আর তাই বা ওদের দেয় কে বলল! এই আমারই একটু মায়া হয় বলে বিকেলের দিকে এসে খাইয়ে যাই।”
নিতাই কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখে বলল, “মনে হচ্ছে এ হল কুমিরের বনসাই।”
সন্ধে হয়ে আসছে বলে দু’জনে আর দাঁড়াল না। করালেশ্বরীর মরা খাত পেরিয়ে দোগেছের মাটিতে পা দিয়েই তারা বুঝল,এ এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম। অনেক পাকা বাড়ি, বাঁধানো রাস্তা আর দোকানপাট দেখা যাচ্ছে।
৩. কয়েক পা এগোতেই
কয়েক পা এগোতেই একজন বেশ আহ্লাদি চেহারায় লোকের সঙ্গে তাদের মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল। ধুতি পাঞ্জাবি পরা, গোলগাল চেহারা আর হাসি হাসি মুখের লোকটা তাদের দেখেই বলে উঠল, “এই যে, তা কোথা থেকে আসা হচ্ছে?”