নিতাই গা ঝাড়া দিয়ে বসল। তার ভয়ডর কেটে গেছে। সে বেশ চেঁচিয়েই বলে উঠল, “তা বললে হবে কেন ঠাকুমা? আমার যে অনেকদিন ধরে ঘোড়া হওয়ার বড় শখ! আপনি ঘোড়া বানিয়ে দেবেন বলে কত আশা করে বসে ছিলাম। কিন্তু এ তো দেখছি জোচ্চুরি! আঁ! এ যে দিনে ডাকাতি! এ যে সাঙ্ঘাতিক লোকঠকানো কারবার!”
গনা ডাইনি আকুল হয়ে বলল, “ওরে চুপ! চুপ! লোকে শুনতে পেলে যে গনা ডাইনির বাজার নষ্ট হবে! চুপ কর ভাই, যা চাস দেব।”
নিতাই মাথা নেড়ে বলল, “না না, আমি কিছু চাই না, আমি শুধু ঘোড়া হতে চাই। ঘোড়া হব বলে সেই কতদূর থেকে আসা! এত নামডাক শুনেছিলুম আপনার, এখন তো দেখছি পুরোটাই ফাঁকিবাজি।”
“চেঁচাসনি বাপ, চেঁচাসনি। লোকে শুনলে দুয়ো দেবে যে আমাকে! তা কী খাবি বাপ, বল তো! ভাল চিড়ে, মুড়কি, ঝোলা গুড়, পাকা কাঁঠাল আর তালের বড়া হলে হবে? সঙ্গে বিচেকলাও দেব’খন।”
নিতাই একটু নরম হয়ে বলল, “এ তো নাকের বদলে নরুন হল গো ঠাকুমা! তা কী আর করা যাবে, তাই আনুন দেখি।”
ওদিকে ফটিক পালালেও বেশিদূর যায়নি। নিতাই আসছে না দেখে সেও গুটিগুটি ফিরে এল। তারপর আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখল, নিতাই কদমগাছের তলায় পিড়িতে বসে বিরাট ফলার সাঁটাচ্ছে। খিদে ফটিকেরও পেয়েছে। সুতরাং ভয়ডর ঝেড়ে ফেলে সেও গিয়ে নিতাইয়ের পাশে বসে পড়ল।
গনা ডাইনি ঘর থেকে বিচেকলা নিয়ে বেরিয়ে এসে ফটিককে দেখে বলল, “ওমা! এ আবার কে রে?”
নিতাই একটু হেসে বলল, “আমিও একটু-আধটু মন্তর জানি গো ঠাকুমা। তোমার বাড়ি ছাগলটাকে মন্তর দিয়ে পটু নস্কর বানিয়ে দিয়েছি ফের। দাও, ওকেও ফলার দাও। আহা বেচারা কতকাল ঘাসপাতা খেয়ে আছে।”
গনা ডাইনি উচ্চবাচ্য না করে ফটিককেও দিল।
খুব খেল দু’জনে। খেয়ে খেয়ে টান হয়ে গেল। তারপর জল খেয়ে উঠে পড়ল, “চলি গো ঠাকুমা।”
গনা ডাইনি বলল, “আয় বাছা, আজকের বৃত্তান্তটা যেন পাঁচকান করিসনি।”
“পাগল! এসব গুহ্য কথা কি কাউকে বলতে হয়?”
রাস্তায় এসে হাঁটতে হাঁটতে ফটিক বলল, “তোর কি দুর্জয় সাহস? ডাইনির ডেরায় কোন সাহসে ঢুকলি, যদি পাঁকে পুঁতে ফেলত বা গোরু ভেড়া করে দিত?”
“ধুস! গোরু ভেড়া হতে যাব কেন? আমি একটা সাদা ঘোড়া হয়ে যাচ্ছিলাম। সেসব কথা পরে হবে। ওই দ্যাখ, অষ্টভুজার মন্দির।”
ফটিক বলল, “ওখানে আর দাঁড়ানোর দরকার নেই। চল দৌড়ে পেরিয়ে যাই।”
নিতাইয়ের এখন সাহস খুব বেড়ে গেছে। বলল, “পালাব কেন? সব দেখেশুনে নেওয়া ভাল, অভিজ্ঞতায় জ্ঞান বাড়ে।”
অষ্টভুজার মন্দির হেসেখেলে এক-দেড়শো বছরের পুরনো হবে। চারদিকে মস্ত মস্ত বটগাছ। বটের ঝুরি নেমে জায়গাটা এই বিকেলবেলাতেও অন্ধকার করে রেখেছে। মন্দিরের চত্বরে ঢুকতেই তারা শুনতে পেল একটা গুরুগম্ভীর গলা মন্দিরের ভেতর থেকে বলছে, “মা! মা! নররক্ত চাই মা করালবদনী? নরবলি চাস মা? আজ অমাবস্যার রাতেই নরবলি দেব মা!”
ফটিকের মুখ শুকিয়ে গেল। কাঁপা গলায় বলল, “শুনছিস?”
নিতাই বলল, “শুনছি, কিন্তু ভয় খাস নে। লোকটাকে একটু বাজিয়ে দেখতে হবে।”
এই বলে নিতাই হঠাৎ বিকট একটা হাঁক মারল, “ঠাকুরমশাই আছেন নাকি? ঠাকুরমশাই!”
ভেতরে গুরুগম্ভীর গলাটা হঠাৎ থেমে গেল। একটু বাদে যে লোকটা মন্দির থেকে বেরিয়ে এল তাকে দেখে ফটিকের মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়। ঘাড়ে গর্দানে বিশাল চেহারা, পরনে টকটকে লাল রক্তাম্বর, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে তেল সিঁদুরের ত্রিশূল আঁকা, চোখ দুখানা ভাঁটার মতো জ্বলছে।
বজ্রগম্ভীর স্বরে লোকটা জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কারা? কী চাও?”
নিতাই বেশ গলা তুলে বলে উঠল, “পেন্নাম হই ঠাকুরমশাই! তা অনেকদূর থেকে আসছি। শুনলুম এই অষ্টভুজার মন্দিরে নিয়মিত নরবলি হয়। সেই শুনেই আসা।”
লোকটা বলল “অত চেঁচামেচি করার দরকার নেই। ওতে মায়ের বিশ্রামের ব্যাঘাত হয়।”
নিতাই গলা একটুও না নামিয়ে ফের চেঁচিয়ে বলল, “বড় আশা করে এসেছি যে ঠাকুরমশাই। এসেই শুনতে পেলুম আপনি আজ রাতেই মায়ের সামনে নরবলি দেবেন। আমাদের ভাগ্যটা ভালই, কী বলেন!”
লোকটা অস্বস্তি বোধ করে চারদিকে চেয়ে নিয়ে চাপা গলায় বলল, “তোমরা ভুল শুনেছ।”
নিতাই দুঃখের গলায় বলল, “এঃহেঃ, এতবড় একটা ভুল খবর পেয়ে এতদুর এলাম। নরবলি দেখার যে খুব সাধ ছিল মশাই!”
লোকটার চোখ হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে উঠল, বজ্রনির্ঘোষে বলে উঠল, “দেখতে চাও?”
নিতাই কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ কোথা থেকে দুটো মুশকো লোক এসে দু’দিক থেকে ধরে তাকে পেড়ে ফেলল। তারপর চোখের পলকে হাত দুটো পিছমোড়া করে আর পা দুটোও বেঁধে তাকে হাড়িকাঠে উপুড় করে ফেলে গলার কাছে খিলটা আটকে দিল।
জবরদস্ত লোকটা চেঁচাচ্ছিল, “ওরে তাড়াতাড়ি কর! তাড়াতাড়ি কর! সতীশ দারোগা এসে পড়বে।”
দুটো মুশকো লোক, একজন দৌড়ে গিয়ে একটা ঢাক নিয়ে এসে ট্যাং ট্যাং করে বাজাতে লাগল, অন্যজন একখানা চকচকে খাঁড়া এনে বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে “জয় মা, জয় মা অষ্টভুজা! জয় মা নৃমুণ্ড-মালিনী” বলে নিতাইয়ের চারদিকে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরতে লাগল।
ঠাকুরমশাই উচ্চস্বরে বলির মন্ত্র পড়ছেন আর মাঝে-মাঝে বলে উঠছেন, “নররক্ত চাই মা? নরবলি চাই মা? তোর ইচ্ছেই পূর্ণ হোক।”