কালু ডাকাত ফের গাছে উঠতে উঠতে বলল, “যাবি তো যা। তবে লোককে সিকির কথাটা বলিস না। তা হলে ওটাই রেট ধরে নেবে সবাই।”
নিতাই বলে, “আজ্ঞে না। ওসব গুহ্য কথা কি কেউ ফাঁস করে?”
কালু ডাকাতের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে দু’জনে তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগল।
জঙ্গল পেরিয়েই একটা ফাঁকা জায়গা। বাঁ ধারে নাবাল জমি, ডানে ধানখেত। মাঝখান দিয়ে রাস্তা।
ফটিক একটু ভয়-খাওয়া গলায় বলল, “এটাই কি গনা ডাইনির জলা নাকি রে নিতাই?”
নিতাই জবাব দেওয়ার আগেই বাঁ ধার থেকে খোনা সুরে জবাবটা এল, “হ্যাঁ গো ভালমানুষের পো, এটাই গনা ডাইনির জলা। তা তোমরা দুটিতে চললে কোথায়? আহা রে, মুখ যে একেবারে শুকিয়ে গেছে! আয় বাছারা, বসে দুটি ফলার খেয়ে যা।”
ফটিক চমকে উঠে বলল, “বাপ রে! বাঁ ধারে তাকাস না নিতাই, দৌড়ো!”
নিতাই কিছু সাহসী। সে বলল, “দাঁড়া না, রগড়টা দেখেই যাই।”
ফটিক দৌড়ে পালাল বটে, কিন্তু নিতাই পালাল না। সে বাঁ ধারে চেয়ে দেখল, একখানা খোড়ো ঘরের সামনে একজন খুনখুনে বুড়ি লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের চালে দিব্যি লাউডগা উঠেছে, ফলন্ত গাছগাছালি, কলার ঝাড়ও দেখা যাচ্ছে।
নিতাই হেঁকে বলল, “তা কী খাওয়াবে গো ঠাকুমা? আমাদের বড্ড খিদে পেয়েছে।”
বুড়ি বাঁ হাত তুলে লম্বা লম্বা আঙুলে হাতছানি দিয়ে বলল, “আয় বাছা আয়! কত খাবি খেয়ে যা।”
নিতাইয়ের বুকটা একটু দুরুদুরু করল বটে, তবে সে এগিয়েও গেল। এত খিদে পেয়েছে যে, ফলারের লোভ সামলানো মুশকিল। সামনে দিব্যি নিকোনো উঠোন। উঠোনের মাঝখানে একখানা কদম গাছ। চারদিকে গোরু, ছাগল, ভেড়া, কুকুর, বেড়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে।
নিতাই বলল, “তা আপনিই কি গনা ডাইনি ঠাকুমা?”
“তাই তো সবাই বলে রে বাপ, ভয়ে কেউ ধারেকাছে আসে না।”
“তা লোকে ভয়ই বা পায় কেন?”
গনা ডাইনি দুঃখ করে বলল, “খামোখা ভয় পায় বাপ, খামোখা ভয় পায়। চেয়ে দেখ দিকি, কাউকে কি আমি খারাপ রেখেছি! ওই যে দেখছিস ধাড়ি ছাগলটা, ও হল নবগ্রামের পটু নস্কর। এক নম্বরের সুদখোর, ছ্যাঁচড়া, পাজি লোক। দেখ তো এখন কেমন দিব্যি আছে। ঘাসপাতা খায়, চরায় বরায় ঘুরে বেড়ায়। আর ওই যে গোরুটা দেখছিস, ছাই-ছাই রঙা, ও হল গোবিন্দপুরের অতসী মণ্ডল। এমন ঝগড়ুটে ছিল যে, পাড়ায় লোক তিষ্ঠোতে পারত না। ওর স্বামীটা সাধু হয়ে হিমালয়ে চলে গেছে। এখন দ্যাখ তো, অতসী কেমন ধীরস্থির ঠাণ্ডা মেরে গেছে। সাত চড়ে রা কাড়বে না। আর ওই কেলে কুকুরটা কে বল তো! ও হল চরণগঙ্গার হরিপদ দাস। সবাই বলত, খুনে হরিপদ। কত খুনখারাপি যে করেছে তার হিসেব নেই। এখন দ্যাখ, কেমন মিলেমিশে আছে সবার সঙ্গে। কারও খারাপ কিছু করেছি কি, তুই-ই বল। আর ওই জলায় যাদের পুঁতে রেখেছি তাদেরও তো প্রাণে মারিনি রে বাপু। ওই দ্যাখ, গদাই নস্কর কেমন চুরি করা ছেড়ে বকুল গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছে। ওই যে শিমুলগাছটা দেখছিস ও হল হাড়কেপ্পন গণেশ হাওলাদার। আর ওই যে দেখছিস…”
নিতাইয়ের মাথাটা ঝিমঝিম করছিল, ধপ করে কদমগাছটার তলায় বসে পড়ে চোখ বুজে ফেলল। অতি-সাহস দেখাতে গিয়ে বড় ভুল করে ফেলেছে তা বুঝতে পারছে হাড়ে হাড়ে। কিন্তু এখন হাত পা এমন অবশ যে, পালানোর শক্তিও নেই।
গনা ডাইনি খলখল করে হেসে বলল, “মুচ্ছো গেলি নাকি বাপ? তা ভয়টা কীসের? তোর জন্য আমি খুব ভাল ব্যবস্থা করছি। মন্তর পড়ে এই ধুলোপড়া যে-ই গায়ে ছুঁড়ে মারব সেই তুই একটা চনমনে টগবগে সাদা ঘোড়া হয়ে যাবি। ঘোড়া হওয়া কি খারাপ বল! সাদা ঘোড়ার দেমাকই আলাদা।”
নিতাই আধবোজা চোখে চেয়ে দেখল, গনা ডাইনি উঠোন থেকে একমুঠো ধুলো তুলে নিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছে। নিতাই অবশ শরীরে বসে ঘোড়া হওয়ার বিবিধ অসুবিধের কথা ভেবে নিচ্ছিল। প্রথম অসুবিধে, ঘোড়া হলে তার চারটে পা গজাবে বটে কিন্তু হাত দুটো গায়েব হয়ে যাবে। হাত না থাকলে লেখাপড়া করা যাবে না, একটু ছবি আঁকার শখ ছিল তার, তা সেটারও বারোটা বাজল, কালী নন্দীর কাছে তবলার মহড়া নিচ্ছিল, তারও হয়ে গেল। উপরন্তু হাত দিয়ে মেখে ভাতের গরাস মুখে তোলাও ভুলতে হবে। ঘাসপাতা খেতে কেমন লাগে সে জানে না। ওসব তার সইবে কি? পোস্ত চচ্চড়ি, পোড়ের ভাজা, মুগের ডাল বা মাছের ঝোলের কথাও ভুলতে হবে। অসুবিধে আরও আছে। সে শুনেছে ঘোড়ারা দাঁড়িয়ে ঘুমোয়। সে কস্মিনকালে দাঁড়িয়ে ঘুমোয়নি, এখন পেরে উঠবে কী?”
গনা ডাইনি মন্ত্র পড়া শেষ করে মুঠোভর ধুলো তার গায়ে ছুঁড়ে মেরে একগাল হেসে বলল, “নে বাপ, এবার ঘোড়া হয়ে আনন্দে থাক। কোনও ঝায় ঝামেলা আর রইল না।”
নিতাই চিঁ হিঁ হিঁ বলে একটা ডাক ছেড়ে গা-সাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল। ঘোড়া হয়ে তার অন্যরকম কিছু লাগছে না তো! নিজেকে এখনও নিতাই-নিতাই বলেই মনে হচ্ছে যে!
গনা ডাইনি গোল গোল চোখ করে তাকে দেখছিল। এবার ভারী হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে বলল, “নাঃ, মন্তরে কাজ হচ্ছে না তো! আর হবেই বা কী করে? পাঁচ কুড়ি সাত বচ্ছর বয়স হল বাপ, মাথাটার কি কিছু আছে! সব কেমন ভুল হয়ে যায়। অর্ধেক মন্তর বলার পর কেমন যেন ঢুলুনি এসে পড়ে, তারপর আর বাকি মন্তরটা মনেই পড়ে না। মাথাটা বেভুল হয়ে পড়েছে বড্ড।”