“তোর মাথা। লোকটাকে আমার একটুও বিশ্বাস হয়নি। আয় তো, একটা উটকো লোকের কথা শুনে এত ঘাবড়ে যাওয়ার কী আছে? এতই যদি খারাপ জায়গা তা হলে তোর পিসি কি তোকে সেখানে ডেকে পাঠাত?”
ফটিক ভিতু মানুষ। তবু নিতাইয়ের কথাটা একটু ভেবে দেখে বলল, “তা অবশ্য ঠিক, তবে-”
“তবে টবে নয়। আয় তো, যা হওয়ার হবে।”
দু’জনে ফের মহাদেবের নৌকোয় উঠে খাল পেরিয়ে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল।
ফটিক বলল, “মহাদেব লোকটা কোথায় গেল বল তো!”
নিতাই বলল, “শুনলি না তায়েবগঞ্জের হাটের কথা। এখন গিয়ে আমাদের পয়সায় সেখানে ভালমন্দ খাবে।”
সাত-সাতটা টাকার দুঃখে ফটিকের একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। সে বলল, “পিসির চিঠিটাও তো লোকটা নিয়ে গেল।”
নিতাই বলল, “তুই দিতে গেলি কেন?”
ফটিক মুখ চুন করে বলল, “লোকটা যে বলল জাল চিঠি! কেউ আমাদের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে।”
“ওকে বিশ্বাস করাটা ঠিক হয়নি।”
“যাকগে, চিঠি তো আর তেমন কিছু নয়। আমিই তো যাচ্ছি।”
২. হরিপুরের জঙ্গলে
হরিপুরের জঙ্গলে পৌঁছতে বেশি সময় লাগল না। বিকেলের শুরুতেই পৌঁছে গেল তারা।
ফটিক একটু ইতস্তত করে বলল, “ঢুকব রে নিতাই?”
“না ঢুকলে জঙ্গল পেরোবি কী করে? আয় তো।”
জঙ্গল খুব একটা ঘন নয়। ভেতরে দিব্যি একটা শুড়িপথ এঁকেবেঁকে চলে গেছে। দু’জনে ঢুকে পড়ল।
নির্বিঘ্নেই হাঁটছিল তারা। বনটা যেখানে একটু ঘন হয়ে এল সেখানে একটা মস্ত গাছ। গাছের তলায় পা দিতেই হঠাৎ সামনে ঝুপ করে কে একটা লাফিয়ে নামল। দুজনে চমকে উঠে ভয় খেয়ে থমকে দাঁড়াল। লাফ-দেওয়া লোকটার পরনে খাটো মালকোঁচা মারা ধুতি, গায়ে একটা বেনিয়ান, মুখটা লাল একটা গামছায় ঢাকা, হাতে একখানা ছোরা। লোকটা উবু হয়ে বসে তাদের দিকে জ্বলজ্বল করে চেয়ে দেখছিল। হঠাৎ একটু ককিয়ে উঠে বলল, “উঃ, মাজাটা গেছে বাপ। এই বয়সে কি আর লাফঝাঁপ সয়। বলি হাঁ করে দেখছিস কী আহাম্মকেরা? ধরে একটু তুলবি তো!”
নিতাই আর ফটিক চোখাচোখি করে নিয়ে তাড়াতাড়ি গিয়ে লোকটাকে দাঁড় করাল। লোকটা নিতান্তই ছোটখাটো, বয়সও সত্তরের ওপর। নিতাই বলল, “এই জঙ্গলের মধ্যে ছোরা নিয়ে কী করছিলেন?”
লোকটা মুখ বিকৃত করে বলল, “গুষ্টির পিণ্ডি চটকাচ্ছিলাম রে বাপ। নে, আর কথা বাড়িয়ে কাজ নেই, সঙ্গে যা আছে সব দিয়ে এখন মানে মানে কেটে পড়।”
নিতাই অবাক হয়ে বলল, “তার মানে! আপনি কি ডাকাত নাকি?”
মুখের গামছাটা সরিয়ে লোকটা খিঁচিয়ে উঠল, “ডাকাত না তো কী? সঙ নাকি?”
নিতাই হেসে ফেলে বলল, “আমাদের কাছে কিছু নেই। আমরা দু’জনেই গরিব মানুষ।”
লোকটা ভারী হতাশ হয়ে গামছা দিয়ে মুখ মুছে বলল, “সবাই যদি ওই কথা বলে তা হলে আমার চলে কীসে বলতে পারিস? যাকেই ধরি সেই বলে, কিছু নেই, আমরা গরিব। আবার কেউ বলে, পরে দিয়ে যাব। ওরে বাবা, চুরি-ডাকাতিতে কি আর ধারবাকি চলে? এ হল নগদানগদির কারবার।”
ফটিক হাঁ করে লোকটাকে দেখছিল। এবার সাহস করে বলল, “আপনিই কি কালু ডাকাত?”
রোগা লোকটা বুক চিতিয়ে বলল, “তবে?”
“তা আপনাকে তো একা দেখছি! আপনার শাগরেদরা সব কোথায়?”
কালু ডাকাত ভারী বিরক্ত হয়ে মুখোনা বিকৃত করে বলল, “তাদের কথা আর বলিসনি৷ বুড়ো হয়ে কয়েকটা মরেছে, যারা আছে তাদের কতক ঘরগেরস্থালি চাষবাস নিয়ে আছে, কতক আবার বুড়ো বয়সে ধম্মকম্ম নিয়ে মেতে আছে। তাদের অধঃপতন দেখলে চোখের জল চাপতে পারবি না। আমি এখন একাই এই হরিপুরের জঙ্গল সামলাচ্ছি। তা যাকগে সেসব দুঃখের কথা। সঙ্গে একশো দুশো যা আছে দিয়ে ফেল তো, তারপর হালকা হয়ে যেখানে যাচ্ছিস চলে যা। গায়ে আঁচড়টিও পড়বে না।”
নিতাই জিভ কেটে বলল, “ছিঃ ছিঃ, কী যে বলেন কালু ওস্তাদ।
আপনার মতো মান্যগণ্য ডাকাতের কি আমাদের মতো এলেবেলে লোকের ওপর চড়াও হওয়া শোভা পায়! আমাদের বেচলেও একশো দুশো টাকা হবে না।”
“তবে তো মুশকিলে ফেললি। আজ এখন অবধি বউনিটাই হয়নি যে! বিশ পঞ্চাশটা টাকা হয় কিনা বাক্সপ্যাটরা হাতড়ে একটু দেখ দিকি বাপু।”
ফটিক মুখোনা মলিন করে বলে, “বিশ পঞ্চাশ! সে যে অনেক টাকা দাদু!”
কালু করুণ মুখ করে বলল, “আজ মনসাপোঁতায় হাটবার। গিন্নি একটা ফর্দ ধরিয়ে দিয়েছে। তা সেসব আর হবে না দেখছি। তা না হোক, অন্তত বউনিটা করিয়ে দে তো বাপ। পাঁচ দশ যা হোক দে দিকি। এই হাত বাড়িয়ে মুখটা ফিরিয়ে রাখছি। ছুঁচো মেরে হাত গন্ধই হচ্ছে বটে, কিন্তু বউনিটা যে না হলেই নয়।”
নিতাই ব্ল্যাক থেকে একখানা সিকি বের করে কালু ডাকাতের হাতে দিতেই হাতটা মুঠো করে কালু বলল, “কী দিলি? কিছু তো টেরই পাচ্ছি না।”
নিতাই ভারী লাজুক গলায় বলল, “ও আর দেখবার দরকার নেই। পকেটে পুরে ফেলুন।”
“কিছু দিয়েছিস তো সত্যিই?”
“দিয়েছি।”
কালু চোখ না খুলেই বলল, “বড্ড ছোট জিনিস দিয়েছিস রে। এ কি সিকি নাকি?”
নিতাই বলল, “আর লজ্জা দেবেন না। সিকি ছোট জিনিস বটে, কিন্তু আমাদের কাছে সিকিও অনেক পয়সা। আপনার বউনি হয়নি বলেই দেওয়া।”
কালু সিকিটা পকেটে পুরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “দেশে এত গরিব কোত্থেকে আসছে বল ত! গরিবে গরিবে যে গাঁ-গঞ্জ ভরে গেল! এ তো মোটেই ভাল লক্ষণ নয়।”
ফটিক বলল, “আজ্ঞে, দেশের খুবই দুরবস্থা। এবার আমাদের ছেড়ে দিন, অনেকদূরে যাব।”