বলে মহাদেব থেমে গেল।
ফটিক ঝুঁকে পড়ে বলল, “যদি না কী গো মহাদেবদাদা?”
মহাদেব মাথাটাথা চুলকে বলল, “আমার মুশকিল কী জানিস? পেটে কথা থাকে না। কথা চাপতে গেলে পেটে এমন বায়ু হয় যে, তখন সামনে এক হাঁড়ি রসগোল্লা রাখলেও সেদিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না।”
নিতাই বলল, “বায়ু হওয়া মোটেই ভাল নয়। কথা চেপে রাখার দরকারটাই বা কী?”
“তা না হয় বলছি। আগে দুটো টাকা দে। কথারও তো একটা দাম আছে!”
নিতাই অবাক হয়ে বলে, “এই যে পাঁচটা টাকা নিলে!”
“সে তো মগজের দাম। কথার দাম আলাদা। ডাক্তারের যেমন ভিজিট, উকিলের যেমন ফি, তেমনই মহাদেব দাস বুদ্ধিজীবীর কথারও একটু দাম আছে রে।”
গেল আরও দুটো টাকা। মহাদেব টাকাটা পকেটে চালান করে বলল, “হরিপুরের জঙ্গলে গাছে গাছে মেলা হনুমান দেখতে পাবি। তা বলে হনুমান নয় কিন্তু। ও হচ্ছে কালু ডাকাতের আস্তানা। তার শাগরেদরা গাছে ঝুলে ওত পেতে থাকে। যেই জঙ্গলে সেঁধোবি অমনই ঝুপ ঝুপ করে লাফিয়ে নেমে ঘিরে ফেলবে। হাতে দা, টাঙ্গি, বল্লম।”
“ওরে বাবা!”
“সর্বস্ব খুইয়ে জঙ্গল যেই পেরোবি অমনই গনা ডাইনি খানা গলায় ডাক দেবে, “কেঁ যাঁয় রে? আয় বাবা, ফলার খেয়ে যা।”
“বটে!”
“যদি বাঁ দিকে তাকাস তা হলেই হয়ে গেল। জলার মধ্যে টেনে নিয়ে পাঁকে পুঁতে মেরে ফেলবে। নয়তো গোরু ভেড়া বানিয়ে রেখে দেবে। চোখ কান বুজে মাঝখানের সরু পথটা পেরিয়ে গিয়ে পড়বি হারু কাঁপালিকের অষ্টভুজা মন্দিরের চত্বরে। নধরকান্তি ছেলেপুলে দেখলেই হারুর চেলারা ঝপাঝপ ধরে পিছমোড়া করে বেঁধে পাতালঘরে ফেলে রাখবে। অমাবস্যার রাতে খুব ধুমধাম করে মায়ের সামনে বলি হয়ে যাবি।”
ফটিক বলল, “তা হলে কি ফিরে যাব?” মহাদেব মোলায়েম গলায় বলে, “আহা, ফিরে যাওয়ার কথা উঠছে কেন? এসব বিপদ আপদ পেরিয়েও তো কেউ কেউ দোগেছে যায়, না কি? তা মন্দির পেরিয়ে বাঁশবন। সে নিচ্ছিদ্র বাঁশবন, দিনে দুপুরেও ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। ওই বাঁশবনে বহুকাল যাবৎ দুটি কবন্ধ বাস করে আসছে। উটকো মানুষ ঢুকলে ভারী খুশি হয়। তারা তোক খারাপ নয়, তবে তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ হাডু-ডু খেলতে হবে। তা তাদের হাত থেকে ছাড়া পেলে থাকছে শুধু করালেশ্বরীর খাল। তা সে খাল পেরোনো শক্ত হবে। রাসপুরের খালে কুমির না থাকলেও করালেশ্বরীর খালে তারা গিজগিজ করছে। তাদের পেটে রাবণের খিদে। হাঁ করেই আছে। আর সে এমন বড় হাঁ যে, জাহাজ অবধি সেঁধিয়ে যায়।”
ফটিক উদ্বিগ্ন হয়ে বলে, “তা হলে পেরোব কী করে?”
“তা করালেশ্বরীর খালও পেরোনো যায়। কেউ কেউ তো পেরোয় রে বাপু। মানছি, সবাই পেরোতে পারে না, দু-দশজন কুমিরের পেটেও যায়। তা বলে তোরা পারবি না কেন?”
ফটিক বলে, “খেয়া নেই?”
“সেও ছিল একসময়ে। মোট সাতজন মাঝি নৌকোসমেত কুমিরের পেটে যাওয়ায় ও পাট উঠে গেছে। দোগেছের লোকেরা খালের দু’ধারে দুটো উঁচু গাছে আড়া করে দড়ি বেঁধে দিয়েছে। গাছে উঠে ওই দড়িতে ঝুল খেয়ে খেয়ে পেরোতে হয়। কেঁদো কয়েকটা হনুমান ওই সময়ে এসে যদি কাতুকুতু না দেয় বা মাথায় চাঁটি না মারে, আর নীচে উপোসী কুমিরের হাঁ দেখে ভয়ে যদি তোদের হাত পা হিম হয়ে না যায় তা হলে দিব্যি পেরিয়ে যাবি। পেরিয়ে গিয়ে অবশ্য–”
ফটিক সভয়ে জিজ্ঞেস করল, “অবশ্য?”
মহাদেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বলে আর কী হবে? দোগেছে পৌঁছে তো তোরা নটবর রায়ের খপ্পরেই পড়ে যাচ্ছিস। তারপর যে কী হবে কে জানে!”
ফটিক শুকনো মুখে নিতাইয়ের দিকে ফিরে বলল, “কী করব রে নিতাই? এ যা শুনছি তাতে তো ফিরে যাওয়াই ভাল মনে হচ্ছে।”
মহাদেব বলল, “এসেই যখন পড়েছিস পিসির বাড়ি যাবি চলে তখন না হয়–“
ফটিক মাথা নেড়ে বলল, “না মহাদেবদাদা, দোগেছে গিয়ে আর কাজ নেই। আমরা বরং বেলাবেলি ফেরতপথে রওনা হয়ে পড়ি।”
মহাদেব উদাস গলায় বলল, “তা যাবি তো ফিরেই যা, পৈতৃক প্রাণটা তা হলে এ যাত্রায় বেঁচে গেল। চ, তোদের খালটা পার করে দিই।”
নিতাই এবার বলে উঠল, “আমাদের কাছে কিন্তু আর পয়সা নেই।”
মহাদেব হেসে বলল, “পরের জন্য করি বলে আমার আর এ জন্মে পয়সা হল না রে। ঠিক আছে বাপু, বিনিমাগনাই পার করে দিচ্ছি, দুধের ছেলেরা ভালয় ভালয় ফিরে গেলেই হল। দেখি, চিঠিখানা দেখি!”
ফটিক অবাক হয়ে বলল, “কীসের চিঠি?”
মহাদেব বলল, “কেন, এই যে বললি পিসি তোকে চিঠি দিয়ে আসতে বলেছে!”
ফটিক পকেট থেকে পোস্টকার্ডটা বের করে দিতেই ভ্রু কুঁচকে মহাদেব বলল, “এ তো জাল জিনিস মনে হচ্ছে। কেউ তোদের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। চিঠিটা আমার কাছে থাক, ব্যাপারটা বুঝে দেখতে হবে।”
এই বলে মহাদেব চিঠিটা পকেটে পুরে ফেলল। মহাদেব দাসের নৌকোয় উঠে দু’জনে ফের খালের এপারে চলে এল। ফটিক তাড়াতাড়ি নেমে পড়ে বলল, “পা চালিয়ে চল নিতাই।”
নিতাই ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে একটু আড়াল হয়েই বলল, “দাঁড়া।”
“কী হল?”
নিতাই আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখল, মহাদেব দাস এদিকে একটু চেয়ে থেকে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বেশ খুশি-খুশি মুখ করে পিছু ফিরে ডান দিকের রাস্তা ধরে হনহন করে হাওয়া হয়ে গেল।
নিতাই ফটিকের হাত ধরে টেনে বলল, “আয়, আমরা দোগেছে যাব।”
“বলিস কী? শুনলি না কী সাঙ্ঘাতিক জায়গা!”