“নাও হে, উঠে পড়ো। পরের উপকার করতে করতে গতরে কালি পড়ে গেল।”
ফটিক আর নিতাই আর দেরি করল না। জলের ধারে নেমে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে উঠে পড়ল। লোকটা দড়িটা টেনে লহমায় তাদের খালের ওপারে নিয়ে ফেলল।
লোকটা একগাল হেসে বলল, “তায়েবগঞ্জের হাটে যাবে বুঝি? তা আর শক্ত কী? ওই ডান ধারের রাস্তা ধরে গুটিগুটি চলে যাও, মাইল দুই গেলেই খয়রা নদীর ধারে বিরাট হাট। জিনিসপত্র বেজায় শস্তা। আটাশপুরের বিখ্যাত বেগুন, গঙ্গারামপুরের নামকরা ঝিঙে, সাহাপুরের কুমড়ো, তার ওপর নয়ন ময়রার জিবেগজা তো আছেই।”
ফটিক বলল, “না মশাই, আমরা তায়েবগঞ্জের হাটে যাব না। অন্যদিকে যাব।”
লোকটা হঠাৎ তেরিয়া হয়ে বলল, “কেন, তায়েবগঞ্জের হাটটা কি কিছু খারাপ জায়গা নাকি? কত জজ ব্যারিস্টার ও হাট দেখতে আসে তত তোমরা তো কোথাকার পুঁচকে ছোঁকরা। এখন পাঁচটা টাকা ছাড়ো দেখি, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
নিতাই ফস করে বলে উঠল, “খেয়াপারের জন্য পাঁচ টাকা ভাড়া নিচ্ছেন! এ তো দিনে ডাকাতি। ওই পুঁচকে খাল পেয়োনোর ভাড়া মাথাপিছু পঁচিশ পয়সা হলেই অনেক।”
লোকটা অবাক হয়ে বলল, “খেয়াপারের ভাড়া চাইছি কে বলল? ছিঃ ছিঃ, ওইসব ছোটখাটো কাজ করে বেড়াই বলে ভাবলে নাকি? এই মহাদেব দাস ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করে না হে।”
“তবে পাঁচ টাকা নিলেন যে!”
“সেটা তো আমার মাথার দাম। এই যে তোমরা খাল পেরোতে পারছিলে না বলে আমাকে ধরে বসলে, আমাকে মাথা খাটাতে হল, বুদ্ধি বের করতে হল, এর দাম কি চার আনা আট আনা? মহাদেব দাসকে কি খেয়ার মাঝি পেয়েছ নাকি? এ-তল্লাটে সবাই আমাকে বুদ্ধিজীবী বলে জানে, বুঝলে! টাকাটা ছাড়ো।”
.
বিদেশ-বিভুই বলে কথা, তার ওপর লোকটাও বদমেজাজি দেখে আর কথা না বাড়িয়ে ফটিক পাঁচটা টাকা দিয়ে দিল।
মহাদেব দাস টাকাটা জামার পকেটে রেখে একটু নরম গলায় বলল, “না গেলে না যাবে, তবু বলছি তায়েবগঞ্জের হাটটাও কিন্তু কিছু খারাপ জায়গা ছিল না। নয়ন ময়রার জিবেগজা পছন্দ না হলে সাতকড়ির বেগুনি তো রয়েছে। খাঁটি সর্ষের তেলে ভাজা, ওপরে পোস্ত ছড়ানো, চটিজুতোর সাইজ। তা বলে বেশি খেলে চলবে না, পেটে জায়গা রেখে খেতে হবে। ধরো, দশখানা করে খেয়ে তারপর গিয়ে বসলে রায়মশাইয়ের মণ্ডার দোকানে। ইয়া বড় বড় মণ্ডা। বেগুনির পরই মণ্ডা খেতে যেন অমৃত। তাও যেতে ইচ্ছে করছে না?”
ফটিক কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, “খুবই ইচ্ছে করছে, কিন্তু আমাদের উপায় নেই। সন্ধের মধ্যে এক জায়গায় পৌঁছতেই হবে।”
মহাদেব একটু হতাশ হয়ে বলল, “তা যাবে কোথা? কুলতলি নাকি? সেও ভাল জায়গা। আজ সেখানে বোষ্টমদের মালসাভোগ আর দধিকর্দম হচ্ছে। এই তো সোজা নাক বরাবর হেঁটে গেলে ঘণ্টাখানেকের রাস্তা। তা কুলতলিতে কি তোমাদের মামাবাড়ি?”
ফটিক মাথা নেড়ে বলে, “কুলতলি নয়, আমরা যাব দোগেছে।”
মহাদেব দাস খানিকক্ষণ হাঁ করে অবাক চোখে চেয়ে থেকে বলল, “কী বললে?”
“গাঁয়ের নাম দোগেছে।”
মহাদেব ঘন ঘন ডাইনে বাঁয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “না, আমার কান দুটোই গেছে। বঁচির মাও সেদিন বলছিল বটে, ওগো কুঁচির বাপ, তুমি কিন্তু আজকাল কান শুনতে ধান শুনছ। একবার কান দুটো শশধর ডাক্তারকে না দেখালেই চলছে না।”
নিতাই আর ফটিক মুখ-তাকাতাকি করল। দোগেছের নামটা অবধি অনেকের সহ্য হচ্ছে না দেখে তাদের একটু ভয়-ভয়ই করতে লাগল।
এবার নিতাই এগিয়ে এসে বলল, “আচ্ছা মহাদেবদাদা, দোগেছের নাম শুনলেই সবাই চমকাচ্ছে কেন বলতে পারেন?”
মহাদেব দাস একটু দম ধরে থেকে বিরস মুখে বলল, “চমকানোর আর দোষ কী বলোখোকারা! দোগেছে যাওয়া আর প্রাণটা যমের কাছে বন্ধক রাখা একই জিনিস। না হে বাপু, আমি বরং এইবেলা রওনা হয়ে পড়ি।”
নিতাই তাড়াতাড়ি পথ আটকে বলল, “না মহাদেবদাদা, তা হচ্ছে। না। ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলতে হবে।”
মহাদেব দাস বটতলার খালের ওপর ধপ করে বসে পড়ল। তারপর বলল, “উরেব্বাস! সে বড় ভয়ঙ্কর জায়গা হে। না গেলেই নয়?”
ফটিক মাথা নেড়ে বলল, “না গিয়ে উপায় নেই। আমার এক পিসি সেখানে থাকে। জন্মে তাকে দেখিনি কখনও। সেই পিসি চিঠি লিখে যেতে বলেছে। খুব নাকি দরকার।”
চোখ বড় বড় করে মহাদেব বলল, “পিসি! দোগেছেতে কারও পিসি থাকে বলে শুনিনি। তা পিসেমশাইয়ের নামটি কী?”
“শ্রীনটবর রায়।”
নামটা শুনেই মহাদেবের চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। ঘন ঘন ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে সে বলল, “না, না, আমি কিছুই বলতে চাই না।”
ফটিক উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেন, তিনি কি খারাপ লোক?”
মহাদেব একটু খাপ্পা হয়ে বলল, “তাই বললুম বুঝি! নটবর রায়ের নাম তো জীবনে এই প্রথম শুনলাম রে!”
ফটিক আর নিতাই একটু চোখ-তাকাতাকি করে নিল। মহাদেব কিছু চেপে যাচ্ছে।
নিতাই নিরীহ গলায় বলল, “দেখ মহাদেবদাদা, আমরা ভিন গাঁয়ের লোক, এদিকে কখনও আসিনি। দোগেছে কেমন জায়গা একটু খোলসা করে বললে আমাদের সুবিধে হয়।”
মহাদেব উদাস গলায় বলল, “জায়গা খারাপ হবে কেন? পিসির বাড়ি বলে কথা। গেলেই হয়। তবে মাইলটাক গিয়ে হরিপুরের জঙ্গল পড়বে পথে। ওইটে পেরোতে পারলে গনা ডাইনির জলা। তারপর কাঁপালিকের অষ্টভুজা মন্দির। সেখানে এখনও নরবলি হয়। মন্দিরের পর মস্ত বাঁশবন। বাঁশবনের পর করালেশ্বরীর খাল। খাল পেরিয়ে দোগেছে। বাঁ দিকে নাক বরাবর রওনা হয়ে পড়ো। সাঁঝ বরাবর পৌঁছে যাবি, যদি না–”