গজপতিবাবু সবেগে মাথা নেড়ে বললেন, “খুন! কক্ষনো নয়। আমার এলাকায় কম্মিনকালেও খুনটুন হয় না। যা দু-একটা লাশ পাওয়া যায় সেগুলো সব সতীশ দারোগার এলাকায় খুন করে আমার বদনাম করার জন্য এই এলাকায় ফেলে যায়।”
“তবু হুজুর, আপনিই তো এলাকার দণ্ডমুণ্ডের মালিক। একটু এগিয়ে দেখে আসবেন চলুন।”
“পাগল নাকি? খুনটুন আমি একদম পছন্দ করি না। চোখের সামনে ওসব দেখলে রাতে আমার খাওয়াই হবে না। ঘুমেরও বারোটা বাজবে। ও খুনটুন নয়, কেউ আমাকে ভয় দেখাতে চাইছে। চল, তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাই।”
হঠাৎ সামনের অন্ধকার থেকে কে যেন গম্ভীর গলায় বলল, “সেটা খুবই কাপুরুষের মতো কাজ হবে গজপতিবাবু!”
গজপতি টর্চ ফোকাস করে কাউকেই দেখতে পেলেন না। বললেন, “আপনি কে?”
“সেটা অবান্তর। দোগেছে থেকে দুটো নিরীহ ছেলেকে ভুলিয়েভালিয়ে ডেকে এনে এখানে খুন করার ব্যবস্থা হয়েছে। অন্তত দশজন লাঠিয়াল তাদের ওপর চড়াও হয়েছে। আর এদের পেছনে কে আছে জানেন? দুলুবাবু। দুলাল রায়।”
“ও বাবা! সে যে সাঙ্ঘাতিক লোক।”
“হ্যাঁ, খুবই সাঙ্ঘাতিক লোক। নটবর রায়ের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে ওঁর মাথা গরম হয়ে গেছে।”
গজপতি একটু পিছিয়ে গিয়ে বললেন, “তা খুনটা হচ্ছে কেন?”
“কারণটা খুব সোজা। নটবর রায়ের ছেলেপুলে নেই। দুলাল রায়কে পুষ্যিপুত্তুর নিয়েছিলেন, কিন্তু দুলাল বড় হয়ে কুসঙ্গে মিশে উচ্ছন্নে যায়। পনেরো বছর বয়সেই সে জেল খেটেছে। তাই নটবর রায় তাকে ত্যাজ্যপুত্র করেন। নটবর রায় অবশেষে তাঁর স্ত্রীর ভাইপোকে সব লিখে দেবেন বলে পায়রাডাঙা থেকে আনিয়েছিলেন।”
রুমালে কপালের ঘাম মুছে গজপতি বললেন, “তারপর?”
“খবরটা পেয়েই দুলালবাবু নটবর রায়ের মাথা গুলিয়ে দেওয়ার জন্য পনেরোজন লোককে পর পর ফটিক ঘোষ সাজিয়ে ওঁর কাছে পাঠান। আসল ফটিক ঘোষের কাছ থেকে তার পিসির দেওয়া চিঠিটা লোপাট করেন। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হবে না বুঝে ফটিককে ধরাধাম থেকে সরিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছেন। ওই যে লাঠিবাজির শব্দ শুনছেন ওটাই হল সেই আয়োজন। আপনার উচিত ওখানে গিয়ে হাজির হয়ে দুজনকে বাঁচানো।”
“ও বাবা! দুলুবাবুর সঙ্গে কি আমি পেরে উঠব? দশজন লেঠেলও রয়েছে যে!”
“কিন্তু আপনার কোমরে তো পিস্তলও রয়েছে।”
“পিস্তল! আমি জীবনে কখনও পিস্তল ছুঁড়িনি। ওর শব্দে আমার পিলে চমকে যায় যে!”
“তা হলে দুটো নিরীহ ছেলে কি আপনার চোখের সামনেই মরবে?”
“না, না, চোখের সামনে মরবে কেন? চোখের সামনে তো মরছে! আমি তো কিছু দেখতেই পাচ্ছি না। যা হচ্ছে তা চোখের আড়ালেই তো হচ্ছে।”
একটু হাসির শব্দ শোনা গেল। লোকটা বলল, “তা হলে আপনি সতীশ দারোগাকে টেক্কা দেবেন কী করে?”
“ওসব মরাটরা যে দেখতে আমি পছন্দ করি না। ওসব দেখলে আমার খাওয়ায় অরুচি হয়, ঘুম হতে চায় না। কিন্তু আপনি কে বলুন তো?”
“আমিই সতীশ দারোগা।”
“অ্যাঁ! না, না সতীশবাবু, এটা আপনার ঠিক হচ্ছে না। দেশে আইন আছে, নিয়ম আছে, ভদ্রতাবোধ আছে। আপনি আমার এলাকায় ঢুকে সেসবই যে লঙ্ঘন করছেন! এটা কি ভাল হচ্ছে সতীশবাবু?”
“একটু আগেই আপনি আমাকে আপনার শ্বশুর ভেবে প্রণাম করেছেন। যে লোক নিজের শ্বশুরের সঙ্গে অন্য লোককে গুলিয়ে ফেলে সে অতি অপদার্থ লোক।”
কথাটা গজপতি একটু ভেবে দেখলেন। তাঁর মনে হল, সতীশ দারোগা খুব একটা ভুল কথা বলেনি। তিনি একটু ঘাড় চুলকে বললেন, “তা আপনি যখন আমার এলাকায় ঢুকেই পড়েছেন তখন আপনিই বা কেন ছেলে দুটোকে মরতে দিচ্ছেন?”
সতীশ দাবোগা বলল, “মরতে দিতুম না, যদি না একটা অদ্ভুত কাণ্ড দেখতে পেতুম। আপনিও দেখতে পারেন। কোনও ভয় নেই। এগিয়ে আসুন।”
“কিন্তু মরা টরা–”
“আসুন না। এলেই দেখতে পাবেন।”
“আয় রে রামভুজ।” বলে পায়ে পায়ে গজপতি দারোগা এগিয়ে গেলেন। শিবমন্দিরের চাতালে তখন আটটা লোক পড়ে আছে। আর দু’জন মুশকো চেহারার লোক দুটো রোগাভোগা ছেলের সঙ্গে লাঠালাঠি করছে। টর্চের আলো জ্বালতেই স্পষ্ট দেখা গেল ছেলে দুটোর হাতে লাঠির বেদম মার খেতে খেতে লোক দুটো টলছে। তারপর দমাস দমাস করে দু’জন পড়ে গেল।”
অন্ধকার থেকে সতীশ দারোগা বলল, “লড়াই শেষ।”
৮. দোগেছে থানার দারোগা
দোগেছে থানার দারোগার ঘরে রাত দশটার সময় দৃশ্যটা এরকম: একখানা লম্বা বেঞ্চের একধারে বছর ছাব্বিশ-সাতাশ বয়সের একজন তোক ঘাড় এলিয়ে বসে আছে। বেশ তাকওয়ালা চেহারা, তবে এখন তার মাথা ফেটে জামা রক্তে ভেজা, বাঁ হাতটা ভাঙা বলে কোনওক্রমে একটা ন্যাকড়া দিয়ে গলার সঙ্গে ঝোলানো। ইনিই দুলাল রায়। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে বলছেন, দেখে নেব, দেখে নেব। তবে গলার স্বর ভাল ফুটছে না। তাঁর বাঁ পাশে জনাচারেক লেঠেল বসে “উঃ আঃ বাবা রে মা রে” বলে কাতরাচ্ছে। সকলেরই গায়ে কালশিটে, মাথা ফাটা বা হাত-পা ভাঙা। কয়েকজন মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তাদের পাশেই হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। দড়িতে বাঁধা রসিক বৈরাগী।
দারোগার উলটোদিকে নটবর রায়, তাঁর পাশে বঙ্গসুন্দরী দেবী, তার পাশে ফটিক ঘোষ, তার পাশে নিতাই, নিতাইয়ের পাশে গজপতিবাবু। বঙ্গসুন্দরী দেবী ফটিকের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে হাপুস নয়নে কাঁদছেন। দারোগাবাবু তাঁর দিকে একখানা পোস্টকার্ডের চিঠি এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এই আপনার সেই চিঠি।”