তবু এতকাল গজপতি গা করেননি। কিন্তু আজ রামভুজ যে খবর দিয়েছে তাতে স্থির থাকা যায় না। রামভুজ বলেছে, বড়বাবু, আপনার নাম ডোবাতে আজ সতীশ দারোগা আপনার এলাকায় ঢুকে কিছু বদমাশকে ধরে নিয়ে যাবে বলে খবর আছে। এতে তো আপনার খুবই বদনাম হবে। আপনার চোর-ডাকাত যদি সতীশ দারোগা ধরে তা হলে তো একদিন আপনার গদিতেই এসে বসে যাবে। আপনাকে হয়তো টুলে বসে থাকতে হবে।
এই কথা শুনে গজপতি হুঙ্কার দিয়ে বললেন, “এত সাহস সতীশ দারোগার? আমার চোর-ডাকাত ধরার সে কে?না না, কিছুতেই এই অন্যায় বরদাস্ত করা যায় না।”
রামভুজ বলল, “শাবাশ হুজুর! তা হলে আজ সাঁঝের পর চলুন। পাকা খবর আছে আজ সতীশ দারোগা মনসাপোতার জঙ্গলে ঢুকবে।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গজপতি রাজি হলেন। কিন্তু রাজি হয়ে যে কী ভুলই করেছেন তা এখন পদে পদে বুঝছেন। প্রথম কথা, মনসাপোতার জঙ্গল অতি বিচ্ছিরি জায়গা। খানাখন্দে ভরা, কাঁটাওলা আগাছায় ভর্তি, শেয়াল, প্যাঁচা, নানারকম জীবজন্তুর আস্তানা, সাপখোপের ভয়। তা ছাড়া তিনি হাঁটতে পারেন তেমন। এই বিচ্ছিরি জঙ্গলে হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে তিনি হাঁসফাস করছেন। ঘামে সর্বাঙ্গ ভেজা।
গজপতি বললেন, “এ কোথায় এনে ফেললে হে রামভুজ?”
“চুপ হুজুর। বাতাসেরও কান আছে। সতীশ দারোগা যে কোথা দিয়ে কোন ছদ্মবেশে ঢুকবে তার কোনও ঠিক নেই। মনসাপোতার মোড়ে আমাদের সেপাইরা মোতায়েন আছে বটে, কিন্তু তাদের চোখে ধূলো দেওয়া সতীশ দারোগার কাছে জলভাত। বললে বিশ্বাস করবেন না হুজুর, আমাদের সেপাই বিরিঞ্চি একবার ভুল করে সতীশ দারোগাকে নিজের শ্বশুর ভেবে পেন্নাম করে ফেলেছিল।”
গজপতি একটা হুঙ্কার দিলেন, “বটে! তা হলে তো বিরিঞ্চিকে বরখাস্ত করা উচিত।”
“সেইজন্যই তো হুজুর, আজ আপনাকে নিয়ে এসেছি। আর যার চোখকে ফাঁকি দিক, আপনার চোখকে ফাঁকি দেওয়া তো সোজা নয়।”
গজপতি ঘাড় থেকে একটা শুয়োলোকা ফেলে দিয়ে জায়গাটা চুলকোতে চুলকোতে বললেন, “আমার শ্বশুর সেজে এসে আমাকে ঠকানো অত সোজা নয়। আমার শ্বশুরকে আমি বিলক্ষণ চিনি। তিনি ফোকলা, ট্যারা, নুলো আর টেকো। কিন্তু কোথায় সেই ব্যাটা?”
“আসবে হুজুর, এই পথেই আসবে। একটু নজর রাখুন।” হঠাৎ গজপতি বলে উঠলেন, “আচ্ছা গাছের ওপর থেকে কে একজন হেসে উঠল বলল তো!”
রামভুজ বলল, “রাম রাম। আমিও শুনেছি হুজুর। ওসব না শোনার ভান করে থাকুন। মনে হচ্ছে বাঁশবনের কন্ধকাটা দু’জন।”
গজপতি তারস্বরে রামনাম করতে করতে বললেন, “বাড়ি চলো হে রামভুজ…”
“চুপ, চুপ হুজুর! কে যেন আসছে।”
জঙ্গলের সরু পথ ধরে একটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছিল। গজপতি এক হাতে পিস্তল অন্য হাতে টর্চ নিয়ে এগিয়ে গিয়ে বলে উঠলেন, “না, না সতীশবাবু, কাজটা মোটেই ঠিক হচ্ছে না। এটা আমার এলাকা, আমার আশ্রিত সব চোর-ডাকাতকে আপনি ধরার কে?”
টর্চ জ্বেলে যাকে দেখলেন গজপতি তাকে দেখে তিনি স্তম্ভিত। লোকটা দাড়ি-গোঁফওলা, ফোকলা, টেকো, ট্যারা এবং বাঁ হাতটা নুলল। লোকটা ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “গজপতি বাবাজীবন নাকি?”
“এ কী! এ যে শ্বশুরমশাই!” বলে গজপতি গিয়ে তাড়াতাড়ি শ্বশুরমশাইয়ের পায়ের ধুলো নিয়ে একগাল হেসে বললেন, “কখন এলেন?”
“এই সন্ধেবেলাতেই এসেছি বাবা। এসে শুনি তুমি নাকি চোর-ডাকাত ধরতে বেরিয়েছ। কী সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড! এসব কি তোমার সহ্য হয় বাবা? শুনেই তো আমি আর থাকতে না পেরে তোমাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছি। চোর-ডাকাত যাদের ধরার তারা ধরুক তো। তুমি বাড়ি চলে। তোমার জন্য পরোটা আর মাংস রান্না হচ্ছে।”
গজপতি লজ্জার সঙ্গে মৃদু হেসে মাথা নিচু করে বললেন, “ও কিছু নয়। সামান্য কয়েকটা ছিচকে চোর আর আনাড়ি ডাকাতরা একটু গণ্ডগোল করছিল। তা বলছেন যখন, চলুন। তুইও চলে আয় রে রামভুজ।”
শ্বশুরমশাই বললেন, “চলো বাবা, তুমি আগে আগে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলো।”
কয়েক পা যাওয়ার পরই পেছন থেকে রামভুজ বলল, “বড়বাবু, আপনার শ্বশুরমশাই কোথায় গেলেন?”
“তার মানে?”
“উনি তো বিলকুল গায়েব।”
পেছনে টর্চ ফোকাস করে গজপতি অবাক হয়ে বলেন, “তাই তো। শ্বশুরমশাই গেলেন কোথায়?”
রামভুজ বলে, “উনি মোটেই আপনার শ্বশুরমশাই নন। ওই লোকটাই সতীশ দারোগা।”
“বলিস কী? দ্যাখ দ্যাখ, কোনদিকে গেল!”
চারদিকে খুঁজেও লোকটাকে পাওয়া গেল না। গজপতি দুঃখ করে বললেন, “একটু সন্দেহ আমারও হচ্ছিল। লোকটা যেন ঠিক ফোকলা নয়, কালো কালো দাঁতের মতো কী যেন দেখা যাচ্ছিল মুখে। আর নুলো ভাবটাও যেন ইচ্ছে করে করা। টাকটাও যেন কেমন সন্দেহজনক।”
গাছের ওপর থেকে ফের চাপা হাসির শব্দ শুনে গজপতি কঁপা গলায় বললেন, “কে?”
রামভুজ বলল, “রামনাম করুন বাবু, রামনাম করুন।”
দু’জনে দৌড়ে খানিক তফাত হলেন। গজপতি হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, “রামভুজ, এক রাত্তিরের মতো অনেক হয়েছে বাবা। এবার বাড়ি চল।”
“আপনার নাম যে খারাপ হয়ে যাবে বড়বাবু।”
এই সময়ে হঠাৎ সামনের দিকে খটাখট করে একটা শব্দ পাওয়া গেল। কে যেন সেইসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, “খুন! খুন করে ফেলল। বাঁচাও..বাঁচাও…”
গজপতিবাবুর হাত-পা কাঁপতে লাগল। ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বললেন, “কী, কী হচ্ছে বল তো!”
রামভুজ বলল, “খুনখারাপি কিছু হচ্ছে বলে মনে হয়।”