কিন্তু এতসব লাঠি সোঁটার মাঝখানে হঠাৎ ফটিকের হাতেও একটা লাঠি কী করে যেন চলে এল। লাঠিটা হাতে পেয়েই সে লাফিয়ে উঠে দমাদম চার দিকে লাঠি চালাতে লাগল। জীবনে সে কখনও লাঠিস্পর্শ করেনি কিন্তু এখন দিব্যি সে পাখসাট মেরে লাঠি চালাচ্ছে দেখে নিজেই ভারী অবাক হয়ে গেল। আরও আশ্চর্যের বিষয়, অন্ধকারে অন্তত দশ বারোটা লেঠেল তাদের ঘিরে ধরে লাঠি চালাচ্ছে বটে, কিন্তু আর একটাও লাঠি তার শরীরে লাগছে না, হাতে লাঠি বিদ্যুৎবেগে ঘুরে ঘুরে মার ঠেকিয়ে দিচ্ছে।
ফটিক ডাকল, “নিতাই, ঠিক আছিস?”
নিতাই একটু দুর থেকে বলল, “ঠিক আছি। তোর কী খবর?”
ফটিক বলল, “খবর বেশ ভালই। আমি যে এত ভাল লেঠেল কখনও টের পাইনি তো।”
নিতাই বলল, “আমিও পাইনি। চালিয়ে যা।”
ফটিক লাঠির ঘায়ে একজনকে ধরাশায়ী করে চেঁচিয়ে উঠে নিজেকেই বাহবা দিল, “সাবাস!”
নিতাই বলল, “কী হল রে?”
“একটাকে ফেলেছি।”
নিতাই বলল, “ধুস! আমি তিনটেকে ঘায়েল করলাম।”
ফটিকের ভয়-ডর কেটে গিয়ে ভারী আনন্দ হচ্ছিল। সে গুন গুন করে “দুর্গম গিরি কান্তার মরু…” গাইতে গাইতে আর দুজনকে ধরাশায়ী করে বলে উঠল, “নিতাই তোর কটা হল?”
“এই যে চার নম্বরটাকে ফেললাম।”
“চালিয়ে যা।”
ঠকাঠক ঠকাঠক লাঠির শব্দ হতে লাগল। সেই সঙ্গে ফটিকের গান আর প্রতিপক্ষদের মাঝে মাঝে “বাবা রে! মা রে! গেলুম রে।” বলে চিৎকার। নিতাইয়ের লাঠি খেয়ে কে একজন চেঁচিয়ে উঠল, “খুন…খুন করে ফেলল! বাঁচাও…বাঁচাও…”
ফটিক তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, “এঃ, লোকগুলো একেবারে আনাড়ি দেখছি!”
৭. কন্ধকাটাদের মুণ্ডু
কন্ধকাটাদের মুণ্ডু না থাকলেও তাদের কোনও অসুবিধে হয় না। শোনা যায় তাদের চোখ নাক কান সবই থাকে তাদের বুকে। বাঁশবনের দুই কন্ধকাটা দাবা খেলে খেলে ক্লান্ত হয়ে একটু বেড়াতে বেরিয়েছিল। গাছে গাছে মগডাল থেকে মগডালে ঝুল খেয়ে খেয়ে তারা মনসাপোতার জঙ্গলে এসে একটা গাছ থেকে ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে জিবরাচ্ছিল। তখন কন্ধকাটা ক কন্ধকাটা খ-কে বলল, “ওই দ্যাখ, ভুড়ি যাচ্ছে।”
কন্ধকাটা খ বলে, “কার ভুড়ি?”
“গজপতি দারোগার ভুড়ি।”
“তা গজপতি দারোগা কোথায়?”
“হুঁড়ির পেছনে পেছনে আসছে।”
“ও বাবা, সন্ধের পর গজপতি দারোগা আজ বেরোল যে! এ তো ঘোর দুর্লক্ষণ? দেশে অনাবৃষ্টি, মহামারী, ভূমিকম্প কিছু-না-কিছু হবেই।”
“হুঁ। সন্ধের পর গজপতিকে কেউ ঘরের বাইরে দেখেনি বটে। নিশ্চয়ই গুরুতর কারণ আছে।”
“থাকতেই হবে।”
“আয় তবে, মজা দেখি।”
কন্ধকাটা খ হঠাৎ বলল, “ওরে দ্যাখ, দ্যাখ, গড়াইবুড়ি তার বাড়ি ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে!”
কন্ধকাটা ক-ও ভারী অবাক হয়ে গিয়ে বলে, “অ্যাঁ! তাই তো! এ যে খুবই অলক্ষুণে কাণ্ড! দেশে কি শেষে মড়ক লাগবে?”
কন্ধকাটা খ হাঁক দিয়ে বলল, “বলি ও গড়াইবুড়ি, বলি যাও কোথা?”
গড়াইবুড়ি একটা শিমুল গাছের মগডালে ডান পায়ের পাতায় ভর দিয়ে উঁচু হয়ে কী দেখছিল, কন্ধকাটাদের দেখে লজ্জা পেয়ে বলল, “পেন্নাম হই বাবাঠাকুরেরা। ছোঁড়াদুটোকে খুঁজছি।”
“কোন ছেঁড়াদুটো?”
“আর বলবেন না বাবাঠাকুরেরা, দুটি পুষ্যি এসে জুটেছে। বোকার হদ্দ। ডান বাঁ চেনে না। সাঁঝের পর কোথায় বেরুল। বড় ভাবনা হচ্ছে।”
“তুমি তো বাপু নিজের বাড়িটি ছেড়ে কখনও নড়োনি আজ অবধি।”
“নড়ার কি জো আছে বাবা! ও বাড়ির ওপর যে সবার বড় কুনজর। পাহারা না দিলেই দখল করে নেবে।”
“শেষ অবধি কি মায়ার বন্ধনে পড়লে নাকি গড়াইবুড়ি! মরার পর কারও কি ও বালাই থাকে?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গড়াইবুড়ি বলে, “সে তো আমারও ছিল। ছেঁড়াদুটোর মুখ দেখে কী যে হল কে জানে! বড্ড ভাবনা হচ্ছে।”
“আহা ওসব ছেড়ে একটা মজা দেখবে এসো। ওই দ্যাখো গজপতি দারোগা রোদে বেরিয়েছে।”
কিন্তু গড়াইবুড়ি দাঁড়াল না। গাছে গাছে ডিং মেরে হাওয়া হয়ে গেল।
গন্ধকাটা ক আর খ মিলে মজা দেখতে লাগল। কিন্তু তারা মজা পেলেও গজপতি দারোগা মোটেই মজা পাচ্ছিলেন না। সন্ধের পর তিনি বাড়ির বাইরে পা দেন না। ভূতপ্রেত, চোর-ডাকাত, খুনে-গুণ্ডা, সাপখোপ ইত্যাদি নানা অস্বস্তিকর ব্যাপার এই সন্ধের পরই মাথাচাড়া দেয়। তার বহুকালের অভ্যাস হল সন্ধের পর এক বড় বাটি ভর্তি ক্ষীর, দুটি মর্তমান কলা, একধামা খই দিয়ে মেখে খেয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে বসে লুডু খেলা। রাতে থানার কাজকর্ম সেপাইরাই সামলায়। আজ তাকে বেরোতে হয়েছে হেড কনস্টেবল রামভুজ পালোয়নের পাল্লায় পড়ে। একথা ঠিক যে, দোগেছেতে সতীশ দারোগা আসার পর থেকেই গজপতির বদনাম হচ্ছে। সতীশ দারোগা নাকি খুবই করিৎকর্মা, দুর্জয় সাহসী, তার দাপটে নাকি দোগেছেতে চুরি-ডাকাতি, খুনখারাপি বন্ধ। আর গজপতির এলাকায় নাকি অপরাধপ্রবণতা দারুণ বেড়ে যাচ্ছে। শোনা যায় সতীশ দারোগা বহুরূপী। কখনও পাগল বা সাধু, কখনও বা চোর কিংবা ডাকাত সেজে চোর-ডাকাতের সঙ্গে ভাব জমিয়ে তাদের ধরে। এমনকী বাঘ বা গাছ সেজেও নাকি সে জঙ্গলে ঘাপটি মেরে থাকে। প্রায়ই খবর পাওয়া যায় সতীশ আজ চার চোরকে ধরেছে, কিংবা দশ ডাকাতকে। রোজই রামভুজ গজপতিকে এসে বলে, “বড়বাবু, আপনি সতীশ দারোগার চেয়ে কম কীসে? তবু সতীশ দারোগার এত নাম হয়ে যাচ্ছে।”