“এই পুবদিকের রাস্তায় গিয়ে বটতলা থেকে ডাইনে মোড় নিয়ে দু’ ফার্লং, একখানা শিবমন্দির আছে। সেইখানে। তা বাবারা, আমি সাঁঝের পর এখানে হাজির থাকব’খন, পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব।”
“তা হলে তো খুবই ভাল হয়।”
রসিক বৈরাগী বিদায় নেওয়ার পর নিতাই বলল, “কাজটা কি ঠিক হবে রে ফটিক? দুলু গোসাঁইয়ের কথা যা শুনলুম তাতে খুব সুবিধের ঠেকছে না।”
“চিঠিটা যখন ফেরত দিতে চাইছে তখন একবার গিয়ে দেখলে হয়।”
“চিঠিটা তো রসিকের হাত দিয়েই পাঠাতে পারত।”
ফটিক একটু ভেবে বলে, “তা ঠিক। তবে চিঠিটা পেলে পিসির সঙ্গে দেখাটা হয়, নইলে ফিরে গিয়ে বাবাকে কী বলব বল তো?”
এই দোনোমোনো ভাব নিয়েই সন্ধের পর দুজনে ফের বাজারের কাছটায় আগের জায়গায় এসে দাঁড়াল। তারা যে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেছে তা লোকজনের হাবভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। তাদের দেখতে পেলেই মানুষজন তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে হেঁঃ হেঁঃ করে সরে পড়ছে।
“লোকে কি আমাদের একটু ভয়ও পাচ্ছে রে নিতাই?”
“তা পাবে না? ভূতের মন্তর জানি যে।”
“জীবনে কখনও কেউ আমাকে ভয় পায়নি, খাতিরও করেনি। নিজেকে এখন বেশ কেউকেটা মনে হচ্ছে।”
সন্ধে গড়িয়ে একটু রাত হওয়ার পর যখন দোকানের ঝাঁপটাপ বন্ধ হতে লাগল, লোকজন কমে গেল, তখনই একটা দোকানঘরের আড়াল থেকে চাপা গলায় ডাক এল, “বাবারা এই ইদিকে আসুন। বেশি সাড়াশব্দ করার দরকার নেই।”
তারা নিঃশব্দে কাঁচা রাস্তাটা ধরে রসিকের পিছু পিছু চলতে লাগল। কিছুটা যেতেই ঘরবাড়ি শেষ হয়ে ঝোঁপজঙ্গল শুরু হল। ঝিঁঝির শব্দ, প্যাঁচার ডাক আর ঘোর অন্ধকার।
ফটিক বলল, “আর কতদূর, ও রসিকবাবু?”
“এই আর একটু বাবা।” কম করেও মাইলখানেক রাস্তা পেরিয়ে তারা যেখানে এল সেটা রীতিমত জঙ্গল। সামনে বিশাল একটা বটগাছ।
“এই বটতলা বাবা। এবার ডাইনে। চিন্তা নেই, আমার পিছু পিছু চলে আসুন।”
ডানদিকের রাস্তায় ঢুকতেই ফটিক আর নিতাইয়ের গা ছমছম করতে লাগল। বিশাল বড় বড় ঝুপসি গাছের ছায়া, দু’ধারে দেড় মানুষ সমান উঁচু আগাছার জঙ্গল। প্যাঁচা ডাকছে, তক্ষকের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। একঝাঁক শিয়ালের দৌড়, পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। অন্ধকারে হোঁচট খেতে হচ্ছে বারবার।
ফটিক ভয়ে ভয়ে বলল, “এ কোথায় আনলেন রসিকবাবু?”
“কোনও ভয় নেই বাবা, এ রাস্তায় আমার দিনে-রেতে যাতায়াত।”
“আর কতদূর?”
“এই আর একটু।”
নিতাই জিজ্ঞেস করে, “দুলুবাবু লোকটি কেমন বলুন তো!”
“আহা বড় দুর্ভাগা লোক। সব থেকেও কিছু নেই। কপালের ফেরে আলায় বালায় ঘুরে জীবন কাটছে। অতবড় সম্পত্তি পড়ে আছে, অত টাকা, কিন্তু সেই কার যেন ভাজা শোলমাছ হাত ফসকে পালিয়ে গিয়েছিল। দুলুবাবুর সেই অবস্থা।”
“তা বিষয়সম্পত্তির কী হল?”
“সে বড় দুঃখের কথা বাবা। তিনি ছিলেন রায়মশাইয়ের পুষ্যিপুত্তুর। যেমন-তেমন নয়, লেখাপড়া করা পুষ্যিপুত্তুর। পাঁচ বছর বয়সে পুষ্যিপুত্তুর হলেন, আর কুড়ি বছর বয়সেই ত্যাজ্যপুত্তুর।”
পুষ্যিপুত্তুর শুনে ফটিক চাপা গলায় বলল, “হ্যাঁ রে নিতাই, নদিয়াদা না এক পুষ্যিপুত্তুর সম্পর্কে সাবধান থাকতে বলেছিল?”
কথাটা শুনতে পেয়ে রসিক থমকাল, “কার কথা বলছেন বাবা?”
নিতাই বলল, “নদিয়া নামে কাউকে চেনেন? আপনাদের লাইনেরই লোক।”
অবাক গলায় রসিক বলে, “না তো, এ নামে তো কেউ নেই। কোথায় দেখা হল তার সঙ্গে?”
“কাল রাতে, চণ্ডীমণ্ডপে।”
“চেহারাটা কেমন বাবা?”
“অন্ধকারে আবছা দেখা। লম্বাচওড়া বলেই মনে হল।”
রসিক হঠাৎ “দাঁড়ান বাবা, পেছনের দিকটা একটু দেখে আসি” বলে ফস করে অন্ধকারে উলটোদিকে মিলিয়ে গেল।
ফটিক চাপা গলায় বলে, “আমার একটু ভয়-ভয় করছে।”
“সে আমারও করছে।”
“পালাবি?”
“এই অন্ধকারে পালানোও কি সোজা? যদি পালাই তা হলে ঘটনাটা জানাও হবে না।”
রসিক ফিরে এসে বলল, “চলুন বাবা।”
“পেছনে কী দেখে এলেন?”
“দিনকাল ভাল নয় বাবা, কেউ পিছুটিছু নিয়েছে কিনা সেটাই একটু দেখে এলুম।”
ফটিক জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা এই রায়মশাইটি কে বলুন তো?”
“আজ্ঞে নটবর রায়, আপনার পিসেমশাই।”
ফটিক অবাক হয়ে বলে, “তার আবার পুষ্যিপুস্তুরও ছিল নাকি?”
“যে আজ্ঞে। রায়মশাইয়ের ছেলেপুলে নেই, অগাধ ধনসম্পত্তি, তাই হরিরামপুরের আশুবাবুর ছেলেকে দত্তক নিয়েছিলেন। তিনিই দুলুবাবু।”
“তা বলে ত্যাজ্যপুত্তুর করলেন কেন?”
“সেও দুঃখের কথা বাবা। রায়মশাইয়ের মায়াদয়া বলে কিছু নেই। পনেরো বছর পেলে পুষে তারপর ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেন। দোষের মধ্যে দুলুবাবু একটু ফুর্তিবাজ ছিলেন আর কী।”
“শুধু সেইজন্য?”
“যে আজ্ঞে। বড় অবিচার হয়েছে বাবা।”
নিতাই বলল, “আর কত দূর?”
“এসে গেছি বাবা, ওই যে শিবমন্দিরের চুড়ো দেখা যাচ্ছে।”
অন্ধকারে জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে আবছা আকাশের গায়ে একটা মন্দিরের চূড়া অস্পষ্ট দেখা গেল। মিনিটখানেক হেঁটে তারা মন্দিরের চত্বরে ঢুকল। চারদিক সুনসান। কোথাও কোনও আলোর রেশমাত্র নেই।
ফটিক সভয়ে বলল, “কই, কেউ তো কোথাও নেই?”
কেউ জবাব দিল না। কিন্তু বাতাসে খুব মৃদু একটা শব্দ হল যেন। আর তারপরেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা ভারী লাঠি ফটিকের বাঁ কাঁধে এত জোরে এসে লাগল যে, সর্বাঙ্গে তীব্র ব্যথার একটা বিদ্যুত্তরঙ্গ খেলে গেল তার। চোখে অন্ধকার দেখে সে বসে পড়ল। হঠাৎ চারদিক থেকে ঝপাঝপ লাঠি নেমে আসছিল।