ফটিক অবাক হয়ে বলল, “ভূতের মন্তর জানি না তো! আর যা যা বললেন সেসবও জানি না।”
“হেঁঃ হেঁঃ, কী যে বলেন বাবা! বিদ্যে কি লুকোনো যায়? জলবসন্ত হলে কি গুটি লুকোনো যায়? না কি সর্দি লাগলে কাশি লুকোনো যায়? না কি আমাশা হলে বেগ চেপে রাখা যায় বাবা? বিদ্যে হল ওই জিনিস, ও বেরিয়ে পড়বেই। কাল যখন আপনারা
গাঁয়ে এসে ঢুকলেন বাবা, তখনই আমি গন্ধটা পেয়েছিলুম।”
নিতাই অবাক হয়ে বলে, “কীসের গন্ধ?”
“আজ্ঞে, অনেকটা মাছের চারের গন্ধ। বড় বড় গুনিনের গায়ে থাকে, ওই গন্ধে ভূত-প্রেত-অপদেবতারা সব তফাত যায়। বাতাস শুকে তখনই আমি আমার ছোট শালাকে ডেকে বলেছিলুম, ওরে রেমো, এই যে দু’জন মানুষ এসে গাঁয়ে ঢুকল এরা যেমন তেমন মনিষ্যি নয় রে। চেহারা দেখে বোঝবার জো নেই, কিন্তু ছুঁচো যেমন গায়ের গন্ধ চেপে রাখতে পারে না, গুনিনরাও তাই।”
ফটিক বলল, “বটে!”
“হেঁঃ হেঁঃ, যতই নিজেকে লুকিয়ে রাখুন বাবা, বিদ্যে লুকোনোর উপায় নেই। গড়াইবুড়ি মরে ইস্তক ও বাড়ির ত্রিসীমানায় কি কেউ যেতে পেরেছে, বলুন তো! কত বড় বড় ওস্তাদ, গুনিন, ওঝা এসেছে, কেউ পারেনি। ঢিল পাটকেল খেয়ে সব পালানোর পথ পায় না। আর আপনারা কেমন ছুঁচ হয়ে ঢুকলেন, আর ফাল হয়ে বেরিয়ে এলেন, গায়ে আঁচড়টিও পড়ল না, বিদ্যে না থাকলে কি হয় এসব? আমরাও ছোটখাটো বিদ্যের চাষ করি কিনা, তাই জানি।”
নিতাই বলল, “তা আপনার কী করা হয়?”
ভারী লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ঘাড় চুলকে রসিক বলল, “সেকথা মুখ ফুটে বলতে লজ্জাই করে বাবা। পেটের দায়ে রাত বিরেতে বেরোতে হয়। ছোটখাটো হাতের কাজ আর কী! তাও কি শান্তি আছে বাবা? সতীশ দারোগা এসে ইস্তক আমাদের ব্যবসাই লাটে উঠবার জোগাড়। কখন যে কোন রূপ ধরে কোথায় উদয় হবেন তার কোনও ঠিক নেই। বোষ্টম সেজে, কাঁপালিক সেজে, পুরুত সেজে, এমনকী চোর-ডাকাত সেজেও ঘুরে বেড়াচ্ছেন।”
ফটিক বলল, “বটে! দারোগা যে আবার চোর-ডাকাত সেজেও ঘুরে বেড়ায়, এ তো কখনও শুনিনি।”
“আর কবেন না বাবা, তাকে জাম্বুবান বললেও কম বলা হয়, তক্কে তক্কে থাকেন, কখন যে ফাঁক করে কার ঘাড় ধরে তুলে নিয়ে যান, সোঁদরবনের বাঘের মতো, তার ঠিক নেই। অথচ দেখুন, দু পা
এগিয়ে মনসাপোতার মোড় পেরোলেই গজপতি দারোগার এলাকা। যেমন তাঁর নাদুসনুদুস চেহারা, তেমনই হাসিখুশি মুখোনি। দেখলেই বুক ঠাণ্ডা হয়। চোর-ডাকাতের মা-বাপ। যা খুশি করুন কেউ ফিরেও তাকাবে না। যত অবিচার সব এই সতীশ দারোগার এলাকায়। এই আমরা দু-চারজনই মাটি কামড়ে পড়ে আছি, যত বড় কারিগররা সব ওই গজপতির এলাকায় গিয়ে সেঁদিয়েছে।”
“তা আপনি যাননি কেন?”
“সেখানে যে বড্ড ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে যাচ্ছে বাবা! অত কারিগর জুটেছে তো, আমাদের মতো চুনোর্পটির সেখানে সুবিধে হচ্ছে না।”
“তা হলে তো আপনার খুব মুশকিল হয়েছে দেখছি।”
“খুব, খুব, দিনকাল মোটে ভাল যাচ্ছে না। এই এখন আপনারা দুটিতে এসেছেন, যদি মারণ-উচাটনবাণ বশীকরণ দিয়ে সতীশ দারোগাকে একটু ঢিট করতে পারেন তা হলে গরিবের বড় উপকার হয়।”
নিতাই বলল, “সে আর বেশি কথা কী? দেব’খন ঢিট করে।”
“আর একটা কথা বাবা। দুলুবাবু আপনাদের সঙ্গে একটু দেখা করতে চান। বড় মনস্তাপে ভুগছেন।”
ফটিক অবাক হয়ে বলে, “দুলুবাবু কে?”
রসিক হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলে, “প্রাতঃস্মরণীয় মানুষ, লোকে বলে এ-তল্লাটের নবীন হুড না কী যেন।”
“রবিনহুড নাকি?”
“আজ্ঞে, তাই হবে।”
“তা তাঁর মনস্তাপ কীসের?”
“বড্ড মনস্তাপ। ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে আর বলছেন, ওরে মহাদেব, তুই এটা কী করলি? চিঠিখানা নিয়ে চলে এলি? আর অবোধ ছেলে দুটো চিঠিখানা দেখাতে পারেনি বলে কী হেনস্থাটাই না হল।”
ফটিক ফুঁসে উঠে বলল, “মানে! কোন চিঠি?”
“আমি তো অত জানি না বাবা, যা শুনেছি তাই বলছি, কী একখানা চিঠি নাকি আপনাদের কাছ থেকে দুলুবাবুর শাগরেদ মহাদেব দাস নিয়ে এসেছিল, আর তাতে নাকি আপনাদের বড় নাজেহাল হতে হয়েছে।”
“সে তো বটেই। মহাদেব দাস অতি পাজি লোক।”
“আজ্ঞে, সেই চিঠিখানা দুলুবাবু ফেরত দিতে চান, আমাকে ডেকে বললেন, ওরে, ছেলে দুটোকে সাঁঝের পর একটু আসতে বলিস তো, ওদের কষ্ট দিয়ে আমার বড় পাপ হচ্ছে।”
ফটিক বলে, “তা সাঁঝের পরে কেন, এখনই যাচ্ছি চলুন।”
জিভ কেটে রসিক দাস তাড়াতাড়ি বলল, “দিনমানে তাঁর সুবিধে নেই কিনা, দিনমানে তিনি গা-ঢাকা দিয়ে থাকেন।”
“কেন বলুন তো!”।
রসিক একটু হেঁ হেঁঃ করে হেসে নিল।
ফটিক আর নিতাই মুখ-চাওয়াচাওয়ি করে নিল। রসিক বৈরাগী মিটমিট করে চেয়ে বলল, “দিনমানে ঘরের বাইরে পা দেওয়ার কি জো আছে তাঁর? অত বড় গুণী মানুষ, চারদিকে এত নামডাক। লোকে একেবারে ঘেঁকে ধরে, হাঁ করে চেয়ে থাকে, পায়ের ধুলো নিতে কাড়াকাড়ি, অটোবায়োগ্রাফি চায়।”
“অটোবায়োগ্রাফি? না অটোগ্রাফ?”
“ওই হল। যাঁহা বাহান্ন, তাঁহা তিপ্পান্ন। আসল কথা হল, দুলুবাবু যখন-তখন হুট বলতে দেখা দেন না। একটু আবডালে থেকে নানা কলকাঠি নাড়াচাড়া করেন। আমি ওঁরই শ্রীচরণের আশ্রয়ে থেকে তালিম নিচ্ছি কিনা।”
ফটিক বলল, “বুঝেছি, চিঠিটা আমাদের খুব দরকার। তা কোথায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হবে?”