নিতাই দরজাটা বন্ধ করে খিল তুলে দিল। তারপর চোখ বুজে হাতজোড় করে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “পেন্নাম হই গড়াইঠাকুমা। এ পর্যন্ত তো আমাদের দিকটা ভালই দেখলে, বাকি কয়েকটা দিনও একটু দেখো। আতান্তরে পড়ে তোমার ঘরে ঢুকে পড়েছি ঠাকুমা, কিছু মনে কোরো না।”
নিতাইয়ের দেখাদেখি ফটিকও একটু লজ্জা লজ্জা ভাব করে দু’হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে গড়াইবুড়িকে পেন্নাম করে বলল, “আমি একটু ভিতু মানুষ গড়াইঠাকুমা। ফস করে আবার রাতবিরেতে দেখাটেখা দিয়ে বোসো না। তাতে পিলে চমকে হার্টফেল হয়ে যেতে পারে। এ যা খেল দেখালে তাতে কালী-দুর্গা কোথায় লাগে। শ্রীচরণে পড়ে রইলুম ঠাকুমা, একটু খেয়াল রেখো।”
তারা গাঁয়ের ছেলে, খিদে একটু বেশিই। তার ওপর দোগেছের জলবায়ুর গুণ আর কালকের ধকলে দু’জনেরই খিদে চাগাড় দেওয়ায় মুখোমুখি দুটো খাঁটিয়ায় বসে তারা নিজেদের পয়সাকড়ি গুনেগেঁথে দেখল। মোট ত্রিশ টাকা আছে। এ থেকে ফেরার ট্রেনভাড়া রেখে যা থাকবে তা কহতব্য নয়।
নিতাই বলল, “দ্যাখ যদি কচুরি-জিলিপি বা মণ্ডা-মিঠাই জলখাবার খাই তা হলে এ টাকা ফুস করে ফুরিয়ে যাবে। আর যদি চিড়েগুড় খাই তা হলে কষ্টেসৃষ্টে কয়েকদিন চলতে পারে।”
ফটিক গম্ভীর মুখে বলল, “হুঁ।”
এ সময়ে হঠাৎ ঘরের পাটাতনের ওপর থেকে দুম করে একটা বড়সড় মাটির ঘট মেঝেতে পড়ে ভেঙে গেল। আর রাশিরাশি খুচরো টাকাপয়সা ঝনঝন করে মেঝেময় ছড়িয়ে পড়ল।
ফটিক চমকে উঠে বলল, “এ কী রে বাবা?”
নিতাই অবাক হয়ে মেঝের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফের চোখ বুজে হাতজোড় করে বিড়বিড় করে বলল, “গড়াইঠাকুমা, এ যে বড় বাড়াবাড়ি করে ফেললে! আর জন্মে কি আমরা তোমার সত্যিকারের নাতি ছিলুম?”
ফটিক বলল, “পরের পয়সা নেওয়া কি ঠিক হবে রে নিতাই?”
“পর! পর কোথায়? ঠাকুমা বলে ডেকেছি না! গড়াইঠাকুমার টাকা তো আর স্বর্গে যাবে না। নিজের গরজে দিচ্ছেন, না নিলে কুপিত হবেন যে!”
“ও বাবা! তা হলে আয় কুড়োই।”
গুনেগেঁথে দেখা গেল, মোট তিনশো বাইশ টাকা। নিতাই বলল, “ওঃ, গড়াইঠাকুমার দেখছি দরাজ হাত।”
ফটিক ভয়ে ভয়ে বলল, “বড্ড দরাজ, এতটা কি ভাল? বিশ পঁচিশ টাকা হলেও না হয় কথা ছিল। তা বলে এত?”
৬. দু’জনে পথে বেরোতেই
দু’জনে পথে বেরোতেই কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে লাগল। মুখোমুখি যার সঙ্গেই দেখা হচ্ছে সেই তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে তাদের নমস্কার করে চট করে রাস্তার পাশে সরে যাচ্ছে। কেউ কেউ গাছপালার আড়ালে লুকিয়েও পড়ল। চণ্ডীমণ্ডপের কাছটায় এক মহিলা বছর পাঁচেকের একটা ছেলেকে হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, টক করে সে নিচু হয়ে ছেলেটার চোখে হাতচাপা দিয়ে বলল, “ওরে, ওদের দিকে তাকাসনি, গুণ করে ফেলবে।”
ফটিক বলল, “এসব কী হচ্ছে বল তো!”
নিতাই মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু, বোঝা যাচ্ছে না।”
আজ কালীমাতা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে ঢুকতেই কালো আর মোটামতো মালিক তাড়াতাড়ি ক্যাশবাক্স ছেড়ে উঠে হাতজোড় করে বলল, “আসুন, আসুন! কী সৌভাগ্য! ওরে, হাতলওলা চেয়ারদুটো এগিয়ে দে।”
ফটিক আর নিতাই একটু মুখ-তাকাতাকি করে নিল, গরম কচুরি আর জিলিপি খাওয়ার পর দাম দিতে যেতেই মালিক জিভ কেটে বলল, “আরে ছিঃ ছিঃ! দাম কীসের? দামটাম দিতে হবে না, বরং গরম সন্দেশ হয়েছে, কয়েকখানা করে খেয়ে যান।”
ফটিক মৃদুস্বরে ডাকল, “নিতাই!”
নিতাই মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু, এখনও বোঝা যাচ্ছে না।” নটবর রায়ের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আজ ভোজপুরি দরোয়ানটা অবধি অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়ায় একটা লম্বা মিলিটারি স্যালুট দিল।
গাঁয়ে চক্কর মেরে যখন তারা নুটুবাবুর লঙ্গরখানায় খেতে ঢুকল তখন সেখানে বেজায় ভিড়, কিন্তু ওই ভিড়ের মধ্যেও তাদের সবাই খাতির করে পথ তো ছেড়ে দিলই, তার ওপর লঙ্গরখানার ম্যানেজারমশাই তাদের দেখেই শশব্যস্তে উঠে হাঁকডাক শুরু করে দিলেন, “ওরে ও জগা, শিগগির ওপরের ঘরে জলের ছিটে দিয়ে দুটো আসন পেতে দে আর ভি আই পি-দের জন্য রাখা কাঁসার থালা-গেলাস বের কর। ঠাকুরকে বেগুন ভাজতে বল, আর ঘি-টা গরম করে দিতে যেন ভুল না হয়, দেখিস বাবা।”
“নিতাই।”
“উঁহু, বোঝা যাচ্ছে না।”
খেয়েদেয়ে বেরোনোর সময় ম্যানেজার হাত কচলে বললেন, “রাতে আপনাদের জন্য একটু পোলাও আর কষা মাংস হচ্ছে। হেঁঃ হেঁঃ। একটু দই মিষ্টিও-”
“আচ্ছা, আচ্ছা।” বলে দু’জনে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এল। বাজারের কাছ বরাবর একটা দোকানঘরের পেছন থেকে একটা লোক ফস করে বেরিয়ে এসে ভারী বিগলিত মুখে সামনে দাঁড়াল, “পেন্নাম হই বাবারা, দণ্ডবত, তা আপনিই তো ষোলো নম্বর ফটিক ঘোষ বাবা! তাই না?”
ভারী ছোটখাটো চেহারার, ধুতি আর হাফশার্ট পরা লোকটাকে দেখে ফটিক অবাক হয়ে বলে, “ষোলো নম্বর হতে যাব কোন দুঃখে? আমি শুধু ফটিক ঘোষ।”
“তবু দেগে রাখা ভাল। নইলে এত ফটিক ঘোষের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলব যে!”
“অ! আর কিছু বলবেন?”
খুব হেঁ হেঁ করে হেসে হাত-টাত কচলে লোকটা বলে, “অধমের নাম রসিক বৈরাগী। এই পেন্নাম জানাতেই আসা। এত বড় দু’জন গুনিন এসেছেন গাঁয়ে, পেন্নাম জানাতে হবে না? তা বাবা, ভূতের মন্তর তো দেখলুম আপনাদের জলভাত, আর মারণ-উচাটন বশীকরণ তো ধরছিই না, ও তো আপনাদের নস্যি। বলি বাবা, এই বাটি-চালান-ঘটি-চালাননখদর্পণ, ডাকিনী বিদ্যে এসবও কি আসে বাবা?”