ফটিক বারবার বলতে লাগল, “কাজটা ঠিক হচ্ছে না রে নিতাই।”
নিতাই ঠাণ্ডা গলায় বলল, “তোর মতো কিন্তু আমার ভয় করছে। গনা ডাইনি যদি আমাকে ঘোড়া বানিয়ে ফেলত বা অষ্টভুজার মন্দিরে যদি সত্যিই বলি হয়ে যেতুম তার চেয়ে খারাপ আর কী হবে বল। আয় আগে চানটান করে একটু তাজা হই, তারপর যা হওয়ার হবে।”
দু’জনে সবে স্নান সেরে এসে জামাকাপড় পরেছে, এমন সময় বাইরে একটা চেঁচামেচি শোনা গেল। দু’জনে কানখাড়া করে শুনল কে যেন হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে বলছে, “কে রে, কার এত সাহস যে, এবাড়িতে বলা নেই, কওয়া নেই ঢুকে বসে আছে? কার এত বুকের পাটা? আঁ!”
দরজায় দমাদম শব্দ শুনে ফটিক ফের ফ্যাকাসে হয়ে বলল, “ওই যে! এসে গেছে।”
নিতাই গিয়ে দরজার খিলটা খুলে দেখল, কপালে চন্দনের ফোঁটা আর গায়ে নামাবলী জড়ানো একটা ষণ্ডামতো লোক দাঁড়িয়ে। তার দিকে রক্তচক্ষুতে তাকিয়ে বলল, “কে তুই? কার হুকুমে এ বাড়িতে ঢুকেছিস? জানিস এ বাড়ি এখন কার দখলে?”
নিতাই বিগলিত একটু হেসে বলল, “এবাড়ি কি আপনার?”
“আমার নয় তো কার? গড়াইবুড়িকে কড়কড়ে পাঁচশো টাকা দিয়ে এবাড়ি কবে কিনেছি আমি। দলিল আমার সিন্দুকে। তোরা
কোন সাহসে এ-বাড়িতে ঢুকেছিস?”
বলে লোকটা লাফ দিয়ে ঘরে এসে ঢুকল, তারপর পিছু ফিরে হাঁক মারল, “ওরে ও বিশু, লাঠিটা নিয়ে আয় তো দেখি–”
বেঁটেখাটো চেহারার একটা লোক মস্ত একটা লাঠি বাগিয়ে এগিয়ে এল।
ফটিক তাড়াতাড়ি বলল, “আহা, লাঠিসোঁটার দরকার কী মশাই? আমরা না হয় এমনিতেই যাচ্ছি।”
গোবিন্দ সাউ মুখ ভেঙিয়ে বলল, “এমনিতেই যাচ্ছি মানে? যাবে তো বটেই, তোমার ঘাড়ে যাবে। আগে বলো কার হুকুমে ঢুকেছ? এত সাহস হয় কোথা থেকে? আঁ!”
এইসব চেঁচামেচির মাঝখানে হঠাৎ খাঁটিয়ার তলা থেকে একটা
পেতলের ঘটি হঠাৎ লাফ মেরে শূন্যে উঠল, তারপর উড়ে গিয়ে ঠঙাত করে গোবিন্দ সাউয়ের কপালে লাগল।
“বাপ রে!” বলে গোবিন্দ সাউ কপাল চেপে বসে পড়ল মেঝেতে। তারপর চেঁচাতে লাগল, “মেরে ফেলেছে রে! খুন করে ফেললে রে!”
নিতাই আর ফটিক হতভম্ব হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। তারা কেউ ঘটিটা ছুঁড়ে মারেনি! তা হলে কাণ্ডটা হল কী করে?
বাইরে থেকে বিশু বলল, “পালান বাবু, গড়াইবুড়ি ফের খেপেছে।”
গোবিন্দ সাউ কোনওক্রমে দরজার বাইরে গিয়ে ফের গলা সপ্তমে চড়িয়ে চেঁচাতে লাগল, “তোর এত সাহস গড়াইবুড়ি? মরেও তেজ যায়নি তোর?”
বিশু গোবিন্দর হাত ধরে টেনে বলল, “চলে আসুন বাবু, ভূতপ্রেতের সঙ্গে কি লড়াই করে পারবেন? বেঘোরে প্রাণটা যাবে।”
গোবিন্দ খিঁচিয়ে উঠে বলল, “নিকুচি করেছে প্রাণের। প্রাণ যায় তো যাক। এই শুনে রাখ গড়াইবুড়ি, তোকে এই ভিটে থেকে উচ্ছেদ যদি না করি তো আমার নাম গোবিন্দ সাউ নয়। আমি এবাড়িতে শান্তি স্বস্ত্যয়ন করাব, তারপর কীর্তনের দল এনে অষ্টপ্রহর এমন কীর্তন করাব যে, তুই পালানোর পথ পাবি না”।
কথার মাঝখানেই হঠাৎ উঠোনের নারকেল গাছ থেকে একটা ঝুনো নারকেল বোঁটা ছিঁড়ে সাঁ করে ছুটে এসে গোবিন্দ সাউয়ের মাথায় পটাত করে লাগল। গোবিন্দ চিতপাত হয়ে পড়ে চেঁচাতে লাগল, “গেছি রে! ওরে, আমি যে চোখে অন্ধকার দেখছি–”
নারকেল দেখে বিশু দুই লাফে রাস্তায় পড়ে ছুটে উধাও হয়ে গেল।
নিতাই আর ফটিক কিছুক্ষণ বিস্ময়ে হাঁ করে কাণ্ডটা দেখল। তারপর ফটিক বলল, “এসব কী হচ্ছে রে নিতাই! ভূতুড়ে কাণ্ড যে!”
নিতাই বলল, “তাই দেখছি।”
কিছুক্ষণ মূছার মতো পড়ে থেকে গোবিন্দ হঠাৎ মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে বসল। তারপর ফ্যালফ্যাল করে তাদের দিকে চেয়ে বলল, “তোমাদের কিছু করেনি গড়াইবুড়ি?”
নিতাই বলল, “না তো!”
বাঁ হাতে কপাল আর ডান হাতে মাথা চেপে খোঁড়াতে খোঁড়াতে রাস্তায় উঠে গোবিন্দ তাদের দিকে চেয়ে বলল, “আর এক ঘণ্টার মধ্যে যদি এ বাড়ি ছেড়ে চলে না যাও তা হলে কিন্তু আমি থানা থেকে পেয়াদা আনিয়ে–”।
কথাটা ভাল করে শেষ হয়নি, কোথা থেকে একটা ডাঁশা পেয়ারা ছুটে এসে গোবিন্দর ডান গালে খচাত করে লাগল।
“বাপ রে!” বলে গোবিন্দ ঘোড়ার বেগে দৌড়ে পালাল।
নিতাই ফটিকের দিকে চেয়ে বলল, “কিছু বুঝলি ফটিক?”
“হুঁ। গড়াইবুড়ি গোবিন্দ সাউকে পছন্দ করে না।”
“কিন্তু আমাদের করে।”
ফটিক চোখ বড় বড় করে বলল, “তা বলে কি ভূতের বাড়িতে থাকা ভাল?”
“ভূত যদি ভাল হয় তবে অসুবিধে কী?”
ঠিক এই সময়ে সেই সুডুঙ্গে লোকটা ফিরে এসে রাস্তা থেকে হাঁ করে তাদের দিকে চেয়ে বলল, “এ কী! তোমাদের ঘাড় এখনও মটকায়নি!”
নিতাই বলল, “আজ্ঞে না।”
“বলো কী হে! এই যে দেখলুম গোবিন্দ সাউ ছুটে পালাচ্ছে!”
তার মাথায় আলু, গালে ঢিবি, কপাল থেকে রক্ত গড়াচ্ছে, আর তোমাদের গায়ে যে বড় আঁচড়টিও পড়েনি! না না, এ গড়াইবুড়ির ভারী অন্যায়। এটা ভারী একচোখোমি। আজ অবধি কেউ এ বাড়িতে ঢুকতে পারেনি, তা জানো? চোরাচড় অবধি নয়। গড়াইবুড়ির তাড়া খেয়ে সবাইকেই সটকাতে হয়েছে। তা হলে তোমাদের বেলায় অন্যরকম নিয়ম হবে কেন? এটা একটা বিচার হল? এতে কি গড়াইবুড়ির ভাল হবে?”
ঠিক এই সময়ে ভেতরের উঠোন থেকে একটা চেলাকাঠ উড়ে এসে ধাঁই করে লোকটার পায়ের গোছে লাগতেই নোকটা “রাম রাম রাম রাম” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে জিরাফের মতো লম্বা লম্বা পা ফেলে উধাও হয়ে গেল।