ফটিক বলল, “ও বারা, ও বাড়িতে নির্ঘাত সাপখোপ আছে।”
“গাঁয়ের ছেলে হয়ে সাপখোপ ভয় পেলে কি চলে? একটু সাবধানে থাকলে ভয়টা কীসের? চারটে দেওয়াল, মাথার ওপর ছাদ–আর চাই কী?”
নিতাই বলল, “থাকার ব্যবস্থা না হয় হল, কিন্তু খাওয়া?”
“দোগেছেকে যতটা খারাপ জায়গা বলে ভেবেছ, ততটা কিন্তু নয়। কুমোরপাড়ার মোড়ে নুটুবাবুর লঙ্গরখানা দেখতে পাবে। দু’ বেলা গরম ভাত, ডাল, তরকারি।”
ফটিক নাক সিঁটকে বলল, “লঙ্গরখানা! সেখানে তো ভিখিরিরা খায়।”
নোকটা নির্বিকারভাবে বলল, “তা খায়। ভিখিরিরা যায় বলে কি বাবুদের গালে উঠছে না নাকি? এ, যেন নবাবপুর এলেন। কালীমাতা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে বসে গুচ্ছের চপ, শিঙাড়া, জিলিপি, অমৃতি গিলে পেট গরম করার চেয়ে নুটুবাবুর লঙ্গরখানার গরম গরম ডালভাত কি খারাপ হল?”
নিতাই বলল, “না না, নুটুবাবুর লঙ্গরখানাই ভাল কিন্তু আমরা যে কালীমাতা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে বসে চপ, শিঙাড়া, জিলিপি আর অমৃতি খেয়েছি তা আপনি জানলেন কী করে?”
লোকটা তেমনই নির্বিকার গলায় বলল, “চোখকান খোলা রাখলেই জানা যায়। তোমাদের দোষ কি জানো? ভগবান দুটো চোখ দিয়েছেন, এক জোড়া কান দিয়েছেন, কিন্তু সেগুলো ঠিকমতো ব্যবহার করতেই শিখলে না। ছ্যাঃ ছ্যাঃ। যাকগে, ভোর হয়ে আসছে। আমি চলি।”
নিতাই বলল, “আপনার নামটা তো জানা হল না!”
লোকটা মাথা চুলকে বলল, “নাম! এই তো মুশকিলে ফেললে, কোন নামটা বলি বলল তো!”
“যেটা খুশি।”
“তা হলে তোমরা আমাকে নদিয়াদা বলে ডাকতে পারো। তবে বেশি খোঁজখবর করতে যেও না, তা হলে বিপাকে পড়বে। দরকারমতো আমি উদয় হব’খন।”
ফটিক হঠাৎ বলল, “গড়াই বুড়ির বাড়িতে তালা দেওয়া থাকলে ঢুকব কী করে? লোকে যদি চোর বলে ধরে?”
‘তালাটালা নেই, দড়ি দিয়ে কড়া দুটো বাঁধা আছে। আর যদি লোকে চোর বলে ধরে ঘাতক দেয়ই, তা হলে হাসিমুখে সেটা হজম করে নিও। হাটুরে কিল খেলে মানুষ পোক্ত হয়। আর একটা কথা। পুষ্যিপুত্তুরকে খুব হুঁশিয়ার।”
এই বলে লোকটা উঠে অন্ধকারে ফুস করে মিলিয়ে গেল।
ফটিক বলল, “ধ্যেত, এ লোকটা আমাদের ফাঁদে ফেলতে চাইছে।”
নিতাই মাথা নেড়ে বলল, “আমাদের ফাঁদে ফেলে কী লাভ? আমাদের আছেটা কী বল তো! কিন্তু পুষ্যিপুত্তুরটা আবার কে?”
“কে জানে! চোরছ্যাঁচড়ের কথায় বিশ্বাস করা ঠিক নয়। চল, আমরা ফিরেই যাই।”
“ফিরে যাওয়া তো আছেই। কিন্তু রহস্যটা কী, কেন এত ফটিক ঘোষ এখানে আসছে সেটা তো আর জানা হবে না, লোকটা হঠাৎ পুষ্যিপুতুরের কথাই বা বলে গেল কেন? আমার মনে হচ্ছে, একটু কষ্ট করে দুটো-একটা দিন থেকে যাওয়াই ভাল।”
ফটিক একটু গাঁইগুই করে রাজি হল। বলল, “কিন্তু বিপদ আপদ হলে কিন্তু তুই দায়ী।”
“বিপদআপদ তো কপালে আছেই মনে হচ্ছে। আর সেইজন্যই আমার মনটা চনমন করছে। পায়রাডাঙা ফিরে গিয়ে কোন লবডঙ্কা হবে বল তো!” ফটিক একটু ভেবে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “তা ঠিক।”
৫. সকালের আলো
সকালের আলো ফুটতেই দু’জনে বেরিয়ে পড়ল, সোজা বেশ খানিকটা গিয়ে ডানধারে একটা কাঁচা রাস্তা। লোকবসতি বিশেষ নেই। বড় বড় গাছের ছায়ায় রাস্তাটা অন্ধকার হয়ে আছে। প্রথমদিকে দু-চারখানা কুঁড়েঘর দেখা যাচ্ছিল বটে, কিন্তু আরও এগোতেই লোকবসতি শেষ হয়ে আগাছার জঙ্গল শুরু হয়ে গেল। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর বাঁ ধারে ছাড়া-ছাড়া জঙ্গলের মধ্যে একখানা ছোট পাকা ঘর দেখতে পাওয়া গেল। দেওয়াল নোনা ধরেছে, দেওয়ালের ফাটলে অশ্বত্থ গাছ গজিয়েছে। দিনের বেলাতেও ঝিঁঝি ডাকছে। ভারী থমথমে জায়গা।
দু’জনে একটু থমকাল। এভাবে পরের বাড়িতে ঢোকার অভিজ্ঞতা তাদের নেই। ফটিক ভয়ে ভয়ে বলল, “ঢোকাটা কি ঠিক হবে রে নিতাই? ভাল করে ভেবে দ্যাখ।”
নিতাই বলল, “আর উপায়ই বা কী বল। কপালে যা আছে হবে। আয় তো দেখি।”
ফটিক বলল, “জায়গাটার কেমন ভূত-ভূত চেহারা।” বাধোবাধো পায়ে দু’জনে হাঁটুভর চোরকাঁটার জঙ্গল পেরিয়ে গড়াইবুড়ির ঘরের দরজা খুলে ঢুকতে যাবে এমন সময়ে পেছনে হঠাৎ কে যেন ফিচ করে একটু হাসল। দু’জনে পেছন ফিরে দেখল একজন সুড়ঙ্গে রোগা বুড়োমতো লোক ফোকলা মুখে খুব হাসছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। চোখে চোখ পড়তেই বলে উঠল, “কী মতলব হে, কী মতলব? দেবেখন গড়াইবুড়ি পিণ্ডি চটকে। বলি গোবিন্দ সাউয়ের মতো ডাকসাইটে লোকই আজ অবধি দখল নিতে পারল না, আর তোমরা কোথাকার কে এসে ঢুকে পড়ছ যে বড়? এই আমি চললুম গোবিন্দ সাউকে খবর দিতে।”
বলে লোকটা হনহন করে হেঁটে ডানধারে কোথায় চলে গেল।
ফ্যাকাসে মুখে ফটিক বলল, “এই রে! কাকে যেন খবর দিতে গেল? এবার কী হবে রে নিতাই?”
নিতাইও একটু ঘাবড়ে গেছে। তবু সাহস করে বলল, “কী আর হবে! যদি বের করে দেয় তো দেবে। আমরা বলব নিরাশ্রয় হয়ে ঢুকে পড়েছিলাম।”
“তোর বড় সাহস।” নিতাই দরজার দড়ি খুলে ভেতরে ঢুকল। পেছনে ফটিক।
ঘরদোরের অবস্থা যতটা খারাপ হবে বলে তারা ভেবেছিল, দেখা গেল ততটা নয়। মেঝেয় ধুলো জমে আছে ঠিকই, একটু ঝুলও পড়েছে চারধারে, তবে বসবাসের অযোগ্য নয়। ঘরে দু’খানা খাঁটিয়া আছে, গেরস্থালির জিনিসপত্রও কিছু পড়ে আছে। ভেতরদিকে উঠোনে পাতকুয়ো, দড়ি বালতি সবই পাওয়া গেল।