- বইয়ের নামঃ ষোলো নম্বর ফটিক ঘোষ
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. রাসপুরের খালের ধারে
ষোলো নম্বর ফটিক ঘোষ – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
রাসপুরের খালের ধারে এসে থমকাল ফটিক। খালের ওপর একখানা জরাজীর্ণ বাঁশের সাঁকো। পেছনে নিতাই। ফটিক তার দিকে ফিরে বলল, “ও নিতাই, হয়ে গেল।”
“হলটা কী?”
“এই সাঁকো পেরোতে হলে হনুমান হতে হয়। অবস্থা দেখছিস!” বাস্তবিক সাঁকোর অবস্থা খুবই কাহিল। পেরনোর জন্য দু’খানা বাঁশ পাতা আছে। বাঁ পাশে একটা বাঁশের রেলিং। কিন্তু পেতে রাখা বাঁশের একখানা মাঝখানে মচাত হয়ে ঝুলছে। রেলিংয়ের বাঁশ কেতরে আছে। নীচে শেষ বর্ষার জলে খাল টইটম্বুর। বেশ স্রোতও আছে।
ফটিক দমে গেলেও নিতাই সবসময়েই আশাবাদী। বলল, “চল, পেরনোর চেষ্টা তো করি। জলে পড়ে গেলে সাঁতরে চলে যাব।”
‘কী বুদ্ধি তোর! আমি কি সাঁতার জানি নাকি? তার ওপর টিনের সুটকেস আর পোঁটলা রয়েছে সঙ্গে, জলে পড়লে সব নষ্ট।”
আশাবাদী নিতাই এবার চিন্তায় পড়ল। খালটা পেরনো শক্তই বটে। বেশি বড় নয়, হাত পনেরো চওড়া খাল। কিন্তু লাফ দিয়ে তো আর ডিঙোনো যায় না। রাসপুরের লোকজনের কাছে তারা পথের হদিস জানতে চেয়েছিল। তারা দোগেছে যাবে শুনে লোকগুলো প্রথমটায় এমন ভাব করল যেন নামটাই কখনও শোনেনি। একজন বলল, “দোগেছে। সেখানে কেউ যায়!” আর একজন বলল,
“দোগেছে যাওয়ার চেয়ে বরং বাড়ি ফিরে গেলেই তো হয়।”
যাই হোক অবশেষে একজন বলল, “বেলাবেলি পৌঁছতে হলে বটতলা দিয়ে রাসপুরের খাল পেরিয়ে যাওয়াই ভাল। তবে কাজটা কঠিন হবে।” কেন কঠিন হবে তা আর ভেঙে বলেনি।
ফটিক পা দিয়ে সাঁকোটা একটু নেড়ে দেখল। একটু নাড়া খেয়েই সাঁকোতে যেন ঢেউ খেলে গেল।
ফটিক পিছিয়ে এসে বলল, “অসম্ভব।”
নিতাই মৃদুস্বরে বলে, “একটু চেষ্টা করে দেখলে হয়। ব্যালান্সটা ঠিক রাখতে পারলে পেরোনো যায়।”
খালের ওপারে একটা বটগাছ। তার ছায়ায় একটা লোক উবু হয়ে বসে ছিল। এবার উঠে এগিয়ে এসে বলল, “কী খোকারা, খাল পেরোবে নাকি?”
নিতাই বলল, “হ্যাঁ। কিন্তু কী করে পেরোব?”
“কেন, ওই তো সাঁকো। সবাই পেরোচ্ছে।”
“পেরোচ্ছে! পড়ে যায় না?”
“তা দু-চারটে পড়ে। আজ সকালে হর ডাক্তার আর বৃন্দাবন কর্মকার পড়ল। দুপুরে পড়ল নব মণ্ডল, সীতারাম কাহার আর ব্রজ দাস। বরাতজোর থাকলে পেরিয়েও যায় কেউ কেউ।”
“না মশাই, আমরা ঝুঁকি নিতে পারব না। সঙ্গে জিনিসপত্তর আছে। আচ্ছা, খালে জল কত?”
লোকটা মোলায়েম গলায় বলে, “বেশি না, বড়জোর ছ-সাত হাত হবে। সাঁতার দিয়েও আসতে পারো। তবে–” বলে লোকটা থেমে গেল।
নিতাই বলল, “তবে কী? জলে কুমিরটুমির আছে নাকি?” লোকটা অভয় দিয়ে বলল, “আরে না। এইটুকুন খালে কি আর কুমির থাকে? তবে দু-চারটে ঘড়িয়াল আর কামট আছে বটে। তা
তারা তো আর তোমাদের খেয়ে ফেলতে পারবে না। বড়জোর হাত বা পায়ের দু চারটে আঙুল কেটে নেবে, কিংবা ধরো পেট বা পায়ের ডিম থেকে এক খাবলা করে মাংস। অল্পের ওপর দিয়েই যাবে অবশ্য। আজ সকালেই হরবাবুর ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটা গেল কিনা।”
ফটিক ফ্যাকাসে মুখে বলল, “বলে কী রে লোকটা!”
লোকটা বলল, “জোঁক আর সাপের কথা তো ধরছিই না হে বাপু। রাসপুরের খাল পেরোতে হলে অতসব হিসেব করলে কি চলে?”
নিতাই বলল, “অন্য কোনও উপায় নেই পেরোনোর?”
“তা থাকবে না কেন? আড়াই মাইল উত্তরে গেলে উদ্ধবপুরে খেয়াঘাটের ব্যবস্থা আছে। আরও এক মাইল উজিয়ে হরিমাধবপুরে পাকা পোল পাবে।”
“তাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। আমরা অনেক দূর থেকে আসছি, বেলাবেলি এক জায়গায় পৌঁছতে হবে। একটা উপায় হয় না?”
লোকটা খুব চিন্তিত মুখে বলল, “দাঁড়াও বাপু, দাঁড়াও। উপায় ভাবতে তো একটু সময় দেবে! পরের ভাবনা ভাবতে ভাবতেই আমার সময় চলে যায়, নিজের ভাবনা আর ভাবার ফুরসতই হয় না।”
“একটু তাড়াতাড়ি ভাবলে ভাল হয়। আমাদের খিদেও পেয়েছে কিনা।”
লোকটা খ্যাঁক করে উঠল, “ওঃ, খিদে তেষ্টা যেন শুধু ওদেরই পায়! আমার পায় না নাকি? ওরে বাপু, খিদে-তেষ্টা পায় বলেই তো জগতের এত সমস্যা। তা তোমাদের কাছে কি গুটিপাঁচেক টাকা হবে।”
ফটিক আশায় আশায় বলল, “তা হবে।”
“বাঃ, বেশ! তা হলে বাঁ ধারে বিশ পা হেঁটে ওই যে ঝোঁপঝাড় দেখছ, ওখানে গিয়ে দাঁড়াও।”
ঝোঁপঝাড়ের দিকে চেয়ে ফটিক সন্দিহান গলায় বলল, “সাপটাপ নেই তো!”
লোকটা নিরুদ্বেগ গলায় বলল, “তা থাকবে না কেন? বর্ষার সময় এখনই তো তারা বেরোয়। আছেও নানারকম। গেছে সাপ, মেছো সাপ, কালকেউটে, গোখরো, চিতি, বোড়া। কত চাই?”
“ও বাবা।”
“আহা, অত ভাবলে কি চলে! সাপেদেরও নানা বিষয়কৰ্ম আছে। শুধু মানুষকে কামড়ে বেড়ালেই তো তাদের চলে না। পেটের ধান্দায় ঘুরে বেড়াতে হয়। একটু দেখেশুনে পা ফেলো, তা হলেই হবে।”
নিতাই বলল, “চল তো, অত ভয় পেলে কাজ হয় না।”
অগত্যা দু’জনে গুটিগুটি গিয়ে ঝোঁপঝাড়ে ঢুকল। কাঁটা গাছ, বিছুটি কোনওটারই অভাব নেই।
চেক লুঙ্গি আর সবুজ জামা পরা বেঁটে লোকটা জলের ধারে এসে খোঁটায় বাঁধা একটা দড়ি ধরে টান দিতেই দড়িটা জল থেকে উঠে এল আর দেখা গেল, দড়ির একটা প্রান্ত এপাশে একটা ছোট নৌকোর সঙ্গে বাঁধা। ঝোঁপঝাড়ের ভেতর লুকোনো ছিল বলে নৌকোটা দেখা যাচ্ছিল না।