লোকটা অবাক হয়ে বলে, “সে কী গো হাবুদাদা, পিতৃদত্ত নামটা থাকতে আবার নতুন নাম রাখতে যাবে কেন? হাবু নামটা তো খারাপ নয়। দিব্যি নাম।”
হাবু নাক সিঁটকে বলল, “এঃ, আমার নাম হাবু নাকি?”
“তবে! এ নামেই তো সবাই তোমাকে চেনে!” হাবু ভাবল, এ লোকটা বোধ হয় অনেক খবর রাখে, এর কাছ থেকেই কায়দা করে সব জেনে নিতে হবে।
হাবু চোখ কুঁচকে বলল, “আচ্ছা, আমার নাম যদি হাবু হয়, তা হলে তোমার নামটা কী হবে?”
লোকটা ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “কাল কদম ওস্তাদের অমন আছাড়টা খেয়েও তোমার মশকরা করতে ইচ্ছে যাচ্ছে? ধন্যি মানুষ বটে তুমি? কাল অমন কুরুক্ষেত্তর হল, তায় সারারাত আমাদের কারও চোখে ঘুম নেই। ওই কালাপাহাড় বিভীষণ এখন কাকে ধরে, কাকে খায় সেই চিন্তাতেই ভয়ে মরছি।
এ সময়ে কি মশকরা ভাল লাগে গো হাবুদাদা?”
হাবু খিকখিক করে হেসে বলল, “পারলে না তো!”
“কী পারলুম না?”
“বলতে পারলে না তো যে, আমার নাম যদি হাবু হয় তা হলে তোমার নাম কী হবে? বলতে পারলে বুঝব তুমি বাহাদুর বটে।”
“আর বাহাদুর হয়ে কাজ নেই বাপু। যা কাল দেখলুম তাতে বাপের নাম ভুলে যাওয়ার জোগাড় তো নিজের নাম।”
হাবু মিটমিট করে চেয়ে বলল, “ভুলে গেছ তো! তা হলে বাপু, ভাল দেখে নিজের একটা নাম রাখলেই তো হয়। আচ্ছা, পাঁচকড়ি নামটা কেমন বলো তো!”
লোকটা ভারী করুণ মুখ করে বলল, “আহা, কতকাল ও নামে কেউ ডাকেনি আমাকে! পিতৃদত্ত নাম, কিন্তু তার ব্যবহারই হয় না। সবাই ‘পাঁচু পাঁচু’ বলে ডেকে ডেকে ও নামটা বিস্মরণই করিয়ে দিয়েছে। তাও ভাল, নামটা মনে করিয়ে দিলে। কিন্তু তুমি জানলে
কী করে বলো তো! এ নাম তো কারও জানার কথা নয়।”
হাবু খুব খিকখিক করে হাসতে লাগল। বলল, “আচ্ছা, এবার তোমাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করছি। খুব ভেবেচিন্তে বলবে কিন্তু! আচ্ছা, বলো তো, আমার নাম হাবু আর তোমার নাম পাঁচু হলে এ বাড়িটা কার?”
পাঁচু হাঁ করে চেয়ে থেকে বলল, “এ আবার কোনদিশি ধাঁধা গো হাবুদাদা? এ হল কর্তাবাবুদের সাতপুরুষের ভিটে। বাচ্চা ছেলেও জানে। রাঘব চৌধুরীর বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলে রাস্তার গোরুটাও পথ দেখিয়ে দেবে।”
হাবু হাততালি দিয়ে বলল, “বাঃ, এই তো পেরেছ। এবার একটা খুব শক্ত ধাঁধা জিজ্ঞেস করছি কিন্তু। ঘাবড়ে যেও না, মাথা ঠাণ্ডা রেখে জবাব দিও। আচ্ছা বলো তো আমার নাম হাবু, তোমার নাম
পাঁচু আর বাড়িটা রাঘববাবুর হলে এ গাঁয়ের নামটা কী?”
“বলি, তোমার মাথাটাই গেছে নাকি? গত দেড় বছর ধরে তো হাট গোবিন্দপুরে থানা গেড়ে আছে, রাতারাতি কি গাঁয়ের নাম পালটে যাবে?”
একগাল হেসে হাবু বলল, “না হে, তোমাকে মেডেল দেওয়া উচিত। তুমি তো দেখছি ধাঁধার ধন্বন্তরি!”
“এখন রসিকতা রেখে খাবারটা খেয়ে নাও। রোজ তোমার বরাদ্দ সকালে কুড়িখানা রুটি। আজ মোটে পনেরোখানার বেশি হল না, ওই যক্ষটাই তো সকালে সত্তরখানা রুটি সাবাড় করল। আমরা ভয়ে কেউ রাটি কাড়িনি।”
কিন্তু খাবারের কথা শুনেও মোটেই চঞ্চল হল না হাবু। খাবে কী, আজ তার এত ফুর্তি হচ্ছে যে, ফুর্তির চোটে খিদেই উধাও। পাঁচু চলে যাওয়ার পর সে উঠে পড়ল। মাজায় ব্যথা, ঘাড় টনটন, হাত পা ঝনঝন, তবু হাবুর গ্রাহ্য নেই। এই নতুন জায়গাটা ভাল করে চিনে নিতে হবে। লোকজনের সঙ্গেও আলাপ সংলাপ করতে হবে। ভাব-ভালবাসা করাটা খুবই দরকার। তার যে বড়ই আনন্দ হচ্ছে।
বাইরে বেরিয়েই সামনে একজন লোককে পেয়ে তাকে একেবারে বুকে টেনে নিয়ে হাবু বলল, “এই যে ভায়া, কতকাল পরে দেখা! আচ্ছা, একটা ভারী মজার প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে? খুব হুঁশিয়ার হয়ে দেবে কিন্তু। ভুল হলেই নম্বর কাটা যাবে। আচ্ছা, বলো তো, আমার নাম যদি হাবু হয়, পাঁচুর নাম যদি হয় পাঁচু, আর এটা যদি রাঘববাবুর বাড়ি হয় আর গাঁয়ের নাম যদি হয় হাট গোবিন্দপুর, তাহলে তোমার নামটা কী হবে! বেশ শক্ত প্রশ্ন কিন্তু।”
লোকটা খুব গম্ভীর হয়ে কর গুনে গুনে অনেকক্ষণ ধরে হিসেব করল। একবার যেন তোর ঘরের নামতাও বলল। এ প্লাস বি হোল স্কোয়ারের কথাও বিড় বিড় করে নিল। একবার মাথা ঝাঁকাল, দুবার ঘাড় চুলকে তারপর হঠাৎ উজ্জ্বল মুখে বলল, “হয়েছে! তোমার নাম হাবু, পাঁচুর নাম পাঁচু, এটা রাঘববাবুর বাড়ি আর গায়ের নাম হাট গোবিন্দপুর হলে আমার নামটা দাঁড়াচ্ছে গোলাপ রায়।”
“বাঃ বাঃ! দশে তোমাকে দশ দিলুম। বুঝলে! দশে দশ।”
গুণেন জানত, একদিন তার গলায় সুর খেলবেই। তার ভিতরে সুরের বারুদ একেবারে ঠাসা। শুধু একটা ফুলিঙ্গের অপেক্ষা ছিল। ওই স্ফুলিঙ্গের অভাবেই তার গলার কামানটা কিছুতেই গর্জে উঠতে পারছিল না। গান সে গাইত বটে, কিন্তু ভিতরে যে সুরের ঠাসাঠাসি তা বেরিয়ে আসতে পারল কই? এই নিয়ে ভারী দুঃখ ছিল গুণেনের কিন্তু বিশ্বাস ছিল একদিন ভগবানের আশীর্বাদ ঠিকই নেমে আসবে তার ওপর। তখন সুরসপ্তক বেরিয়ে এসে চারদিক কাঁপিয়ে দেবে।
কখন যে কার ভাগ্য খোলে তার কিছু ঠিক নেই। ভগবানকে দোষ দিয়ে তো লাভ নেই। তাঁর পাঁচটা কাজ আছে। ব্যস্ত মানুষ। একটা সেরে তবে তো আর একটায় হাত দেবেন! তাই আশায় আশায় অপেক্ষা করছিল গুণেন। কবে ভগবানের হাত খালি হয়, কবে তিনি গুণেনের দিকে তাকান।