“আজ্ঞে, পরশুদিনই জ্বালানির কাজও শেষ হয়েছে।” চোখ বড় করে নন্দলাল বললেন, “হয়েছে?”
“হ্যাঁ, তবে প্রয়োগ এবং পরীক্ষা হয়নি। তার আগেই গতকাল সন্ধেবেলা ওই কালান্তক যম এসে হাজির। ঠাকুরমশাই, আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে আমার আয়ু শেষ। কে বা কারা ওই যমদূতকে পাঠিয়েছে তা জানি না। কাল সন্ধেবেলা যখন একমনে কাজ করছি তখন একটা ফোঁস শব্দ পেয়ে পিছন ফিরে দেখি, জানালা দিয়ে ওই দানবটা আমার দিকে জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে রয়েছে। তখনই আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নড়ে উঠল। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, আমার দিন ঘনিয়ে এসেছে। শেষরক্ষা হয় কিনা সেটাই চিন্তার কথা। আমার এতকালের পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর সাধনা সবই বুঝি বৃথা গেল।”
নন্দলাল একটু চিন্তা করে বললেন, “লোকটাকে দেখে ভয় লাগারই কথা বটে। কিন্তু সে যে তোমাকেই মারতে এসেছে সেটা
তো এখনও সাব্যস্ত হয়নি।”
“তবে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কথা বলছি কেন?”
“বাপু, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কথা শুনেছি বটে, কিন্তু সেটা কী বস্তু তা জানি না। বলি ষষ্ঠ ইন্দ্ৰিয়টা কী জিনিস বুঝিয়ে বলল তো।”
“সে কি ছাই আমিই জানি। তবে মনে হয় সেটা টিকটিকির মতো একটা কিছু হবে। বিপদ ঘনীভূত দেখলেই সেটা টিক টিক করে ডাকতে থাকে।”
“শোনা যায়?”
“আজ্ঞে না, ঠিক শোনা যায় না। তবে টের পাওয়া যায়।”
“তবে আমার টিকটিকিটা ডাকে না কেন? সেটা কি ঘুমিয়ে পড়ল নাকি?”
“বিপদে পড়লে ঠিকই ডাকবে, কিন্তু ঠাকুরমশাই, আমার এত সাধের আবিষ্কারটার কী হবে? নিশুত রাতে প্রাণের ভয়ে উড়ুক্কু ঝাঁটা আর তার ফর্মুলা নিয়ে পালিয়ে এসে বাঁশবনে গা-ঢাকা দিয়ে আছি। কিন্তু এভাবে তো থাকা যাবে না মশাই।”
“দাঁড়াও বাপু, একটু ভাবতে দাও। বলি পেটে দানাপানি কিছু পড়েছে?”
“আজ্ঞে না। দুশ্চিন্তায় ওসব খেয়ালও করিনি।”
“তবে এই দুটো কলা আর খানকয় বাতাসা রাখো। ঠাকুরের প্রসাদ, ভক্তিতে হোক আর অভক্তিতে তোক একটু কপালে ঠেকিয়ে খেও। এ-বেলাটা বাঁশবনেই ঘাপটি মেরে থাকো, আমি ওবেলা আসবখন।”
নন্দদুলাল খুবই দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়িমুখো হাঁটতে লাগলেন। বিশ কদম যেতে না যেতেই বাধা পড়ল।
“পেন্নাম হই ঠাকুরমশাই।”
“কে রে?”
“এই যে আমি!” নন্দলাল চারদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে বললেন, “কই হে, কাউকেই যে দেখতে পাচ্ছি না।”
“আজ্ঞে, দয়া করে একটু ঘাড় তুলে ওপরের দিকে তাকাতে হবে যে!”
নন্দলাল ওপরের দিকে চেয়ে দেখলেন, পুরনো আমগাছটার প্রায় মগডালে ভূতনাথ ঘোড়সওয়ার হয়ে বসা।
“বাপু ভূতনাথ!”
“যে আজ্ঞে।”
“এটা কোন ঋতু, তা খেয়াল আছে?”
“ব্রাহ্মণের আশীর্বাদে এটা তো শরৎকাল বলেই মনে হচ্ছে।”
“তা হলে বাপু, এই শরৎকালে আমগাছে উঠেছ যে বড়? এ তো আমের সময় নয় হে।”
“আজ্ঞে আম নয় ঠাকুরমশাই, খুড়োমশাইয়ের খোঁজে এসেছি।”
“খুড়োমশাই! বলি তোমার খুড়োমশাইয়ের আবার এ-গাঁয়ে কবে আগমন হল? আর এত জায়গা থাকতে বুড়োমানুষ আমগাছেই বা উঠতে গেলেন কেন? পড়ে হাত-পা ভাঙবে যে!”
ভূতনাথ হেসে বলল, “আজ্ঞে সে ভয় নেই। খুড়োমশাইয়ের গাছপালা খুব পছন্দ। হাত-পা ভাঙার উপায় নেই, বায়ভুত জিনিস কি না।”
“হেঁয়ালি ছেড়ে আসল কথায় এসো তো হে।”
“আজ্ঞে। ঠাকুরমশাই, আসল কথাটা বলার জন্যই তো গলা খুসখুস করছে। কিন্তু কাকে বলি বলুন! ভূতনাথের কথা যে কেউ মোটে বিশ্বাসই করতে চায় না। অভয় দেন তো শ্রীচরণে নিবেদন করে ফেলি।”
“তা করে ফেলো বাপু।”
ভূতনাথ গাছ থেকে নেমে এসে ভারী ভক্তিভরে নন্দলালের পায়ের ধুলো নিয়ে জিভে আর মাথায় ঠেকিয়ে বলল, “আজ্ঞে, কথা তো অনেক। কোনটা আগে বলি, কোনটা পরে সেইটেই সমস্যা। কথার সঙ্গে কথার বড় ঠেলাঠেলি হচ্ছে মশাই, ভেতরে।”
“যেটা আগে বেরোতে চাইছে সেটাকেই বের করে দাও।”
“যে আজ্ঞে। গুরুতর কথাটাই বলি তা হলে। আমাদের হাবু দাসের শরীরে যে আর একটাও হাড়গোড় আস্ত নেই সে-খবর কি শুনেছেন?”
নন্দলাল অবাক হয়ে বললেন, “বলো কী হে? হাবু দাস পালোয়ান মানুষ, তার হাড়গোড় তো সহজে ভাঙার কথা নয়। খাট থেকে ঘুমের ঘোরে পড়েটড়ে গিয়েছিল নাকি?”
ভূতনাথ টপ করে আর একবার খাবলা দিয়ে নন্দলালের পায়ের ধুলো নিয়ে গদগদ হয়ে বলল, “আজ্ঞে, আপনি সিদ্ধপুরুষ, অন্তর্যামী। সবই আগেভাগে জেনে যান। বৃত্তান্তটা অনেকটা তাই বটে। তবে তফাত হল, হাবু পড়ে যায়নি, তাকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।”
“অ্যাঁ! কার ঘাড়ে দুটো মাথা?”
“আজ্ঞে, উনি বোধ হয় কল্কি অবতারই হবেন। সেইরকমই চেহারাখানা, দেখলে ভক্তিও হয়, ভয়ও হয়।”
“তা হাবুর দোষটা কী?”
ঘাড়টাড় চুলকে ভূতনাথ বলল, “আজ্ঞে, হাবুদাদার মতো মানুষ হয় না, কারও সাতেপাঁচে নেই। চারটি খাওয়া আর ঘুম। কোথা দিয়ে সূর্যোদয় হয়, কোথা দিয়ে অস্ত যায়, তা উনি টেরও পান না। কানে খড়কে দিন, কালীপটকা ফাটান বা কামান দাগুন, হাবুদাদার ঘুম ভাঙার নয়, ওই ঘুমই তো প্রায় কালঘুম হয়ে যাচ্ছিল আর কী!”
“ভণিতা ছেড়ে আসল কথাটায় এলেই তো হয়।”
“আজ্ঞে, পিছনের কথাটা না বললে সামনের কথাটা তেমন পরিষ্কার হয় না কিনা, তা দোষটা ধরুন হাবুদাদারও নয়, দোষ পাঁচুর। কল্কি অবতারটিকে নাকি কর্তাবাবুই এনেছেন। তা পাঁচু বলল, পালোয়ানের ঘরেই পালোয়ন থাকা ভাল। দু’জনে বেশ মানানসই হবে। এই বলে কল্কি অবতারকে তো পাঁচু হাবু দাসের ঘরেই ঢুকিয়ে দিয়ে গেল। কিন্তু কাঁচাখেগো দেবতাটি বলে বসল, ওই মোটা লোকটা জানালার ধারে ভাল জায়গাটা দখল করে থাকলে তো চলবে না। ওই জায়গাটা আমার চাই। তা পাঁচু মিনমিন করে কী একটু আপত্তি করেছিল যেন। কিন্তু অবতারটি সে-কথায় কান না দিয়ে সোজা হাবু দাসকে নাড়া দিয়ে বলল, ওহে, তোমার বিছানাটা ওই কোণের দিকে নিয়ে যাও, আমি আলো-বাতাস ছাড়া থাকতে পারি না। কিন্তু হাবু দাসের ঘুম ভাঙায় তার সাধ্যি কী! অবতার মানুষ তো, বেশি কথাটথা কইতে জানেন না। এঁরা কাজ ভালবাসেন। বললে বিশ্বাসই করবেন না, তোশকটা ধরে স্রেফ একটা ঝাড়া দিলেন। হাবু দাসের ওই দশাসই বিশমনি শরীরখানা যেন চড়াই পাখিটির মতো উড়ে গিয়ে গদাম করে দশ হাত দূরে পড়ল। কল্কি দেবতার এলেম দেখে আমাদের শরীর হিম হয়ে গেল। পাঁচুর সে কী ঠকঠক করে কাঁপুনি।”